গত অর্ধ শতাব্দীতে চুই ঝালের দাম কয়েকশত গুণ বৃদ্ধি পেলেও চাহিদা এবং ক্রেতা কমেনি, বরং ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর বাজারে এই চুই ঝালের রমরমা ব্যবসা চাহিদা বাড়ার সাধে ব্যবসা বেড়েছে অনেক।
খুলনা অঞ্চলের মানুষের গরুর মাংস রান্নায় চুই ঝালের অনুপস্থিতি যেন তৃপ্তিই মেটে না। দৌলতপুর বাজারে চুই ঝাল বিক্রি সেই বৃটিশ আমল থেকে চালু আছে। উত্তরবঙ্গের রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং পাহাড়ি অঞ্চল এ সুস্বাদু চুই ঝাল উৎপাদনের মূল কেন্দ্র। এটা মূলত: একপ্রকার লতা জাতীয় গাছ। কিছুটা ঝাল এবং সুস্বাদু ঘ্রাণ হওয়ার এর নাম হয়েছে চুই ঝাল। চুই ঝালের মূল ও কা-টাই শুধু রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। এর কা-টা প্রকৃতির এমনই দান যে একটু তাপ পেলে তরকারির পাশাপাশি চুইঝাল নরম হয়ে যায়।
রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং পাহাড়ি এলাকা চুই ঝালের উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র হলেও ঐ এলাকার মানুষ কিন্তু এই চুই ঝাল খেতে অভ্যস্ত নয়। আবার রংপুর ও বগুড়া এলাকার চুই পাহাড়ি এলাকার চুই থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যের। স্বাদও আলাদা। একমাত্র দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে খুলনা অঞ্চলের মানুষ গরুর মাংসের সাথে চুই ঝাল মিশিয়ে রান্না করে থাকেন। শুধু তাই নয় সুস্বাদু হালিম ও ছোলা ভাজার সাথেও চুই ঝাল ব্যবহার করা হয়। যেন চুই ঝাল না হলে উল্লিখিত খাবারগুলোতে অতৃপ্তি থেকে যায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাধীনতার পর দৌলতপুর বাজারে একমণ চুই ঝালের পাইকারি মূল্য ছিল ৮০ টাকা। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় অন্যান্য নিত্য দ্রব্য সামগ্রীর ন্যায় চুই ঝালের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি শুরু হয়। এরপর ‘৮৮ সালে ৬০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৩০০ টাকা মণ বিক্রি হতে থাকে। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৬০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকা এবং বর্তমানে চুই ঝালের গুণগত মান অনুযায়ী পাইকারি মৃল্য মণ প্রতি ১৮ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা।
দৌলতপুর বাজারের একজন চুইঝাল ব্যবসায়ী মোঃ আবদার শেখ। বয়স ৭০ বছর। বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামে। ৩০ বছরের যুব বয়সে বিবাহের পর পারিবারিক অভাব অনটনের মাঝে প্রতিবেশী একজন চুইঝাল ব্যবসায়ী মরহুম আবদুস সাত্তার শেখের পরামর্শে চুইঝালের ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। সেই থেকে শুরু তাঁর এই ভিন্নধর্মী ব্যবসা। প্রথমাবস্থায় দেশের সবচেয়ে বড় চুই ঝালের উৎপাদন কেন্দ্র রংপুর এবং কুড়িগ্রামে প্রতিমাসের ট্রেনে করে এক থেকে দুইবার যেয়ে অপরিচিত কারোর বাড়ি থেকে চুইঝাল সংগ্রহ করে খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর বাজারে বিক্রি শুরু করেন। একটানা ৪০ বছর ধরে চলছে তার এই ব্যবসা। দৌলতপুর বাজারে তিনিই একমাত্র প্রবীণ চুইঝাল ব্যবসায়ী। আগে নিজে যেয়ে চুই ঝাল সংগ্রহ করলেও এখন ব্যবসার ধরণ পাল্টিয়েছে। আড়ৎদারের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে দোকানে বসে চুই ঝাল সংগ্রহ করেন।
দৌলতপুর বাজারের পান সুপারি পট্টির শেষ কর্ণারে ছোট একটি ভাড়া দোকানে বসে চুই ঝাল বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় তাঁর এ ব্যবসার খুটিনাটি বিষয় নিয়ে। তিনি জানান, প্রতি সপ্তাহে রংপুর এবং কুড়িগ্রাম থেকে চালানের মাধ্যমে ২০ থেকে ২৫ কেজি চুই ঝাল আনি। প্রতিদিন একশ' থেকে দেড়শ' ক্রেতা আমার দোকান থেকে চুই ঝাল ক্রয় করে। গুণগত মান অনুযায়ী ১ কেজি চুই ঝালের মূল্য ২০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ৪০ বছর ধরে এই ব্যবসা করে পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দে দিন যাপন করছি। ৪ ছেলে ১ মেয়েকে মানুষ করেছি। গত দুই বছরে করোনার কারণে ব্যবসা কিছুটা মন্দাভাব দেখা দিয়েছিল।
তিনি বলেন, আমার মতো আরো কয়েকজন ব্যবসায়ী দৌলতপুর বাজারে এই চুই ঝাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমার মতো তারাও প্রতি সপ্তাহে ২০ থেকে ২৫ কেজি চুইঝাল আড়ৎদারের মাধ্যমে সংগ্রহ করে।
পান সুপারি পট্টির আবদার শেখের দোকানের পার্শ্ববর্তী ব্যবসায়ী মোঃ ইব্রাহিম জোয়াদ্দার। বয়স ৪০ বছর। এক সন্তানের জনক। বাড়ি যশোর জেলার বসুন্দিয়া। ২০১২ সাল থেকে দৌলতপুর বাজারে তিনিও এই চুই ঝাল ব্যবসার সংগে জড়িত। একই বাজারের সোনাপট্টিতে আরেক চুইঝাল ব্যবসায়ী শেখ আঃ হালিম। দৌলতপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। তিনিও ৮ বছর ধরে একই ব্যবসার সংগে জড়িত।
দৌলতপুর বাজারের বর্তমান প্রবীণ চুইঝাল ব্যবসায়ী মোঃ আবদার শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রতি মাসে দৌলতপুর বাজারে আমরা কয়েক ব্যবসায়ী প্রায় ৫’শ কেজি চুইঝাল বিক্রি করি। ৪০ বছর পূর্বে যখন এ ব্যবসা শুরু করি তখন দৌলতপুর বাজারে ১ কেজি চুই ঝাল বিক্রি হতো মাত্র ২ টাকায়। বর্তমানে প্রকারভেদে ১ কেজির খুচরা মূল্য ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা বিক্রি হলেও এর চাহিদা এবং ক্রেতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।