কথিত ধাত্রী নাসিমা বেগম (৩৮)। পড়ালেখা খুব একটা নেই। জনৈক আরেক কথিত ধাত্রীর সাথে ছিলেন ৬ মাস। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে নাসিমা হঠাৎ সেজে বসেছেন গাইনি চিকিৎসক। সরাইল সদর ইউনিয়নের উচালিয়া পাড়ায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন নাসিমা। গর্ভবতী নারীদের স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করান তিনি। ফি ৬-৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। টার্গেট দরিদ্র ও স্বল্প শিক্ষিত নারীরা। রোগী ম্যানেজ করতে মাঠে রেখেছেন বেশ কিছু মহিলা পুরূষ। যাদেরকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় দালাল। তবে তিনি নিজেকে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বলে দাবী করেন। নাসিমা দীর্ঘদিন ধরে অসহায় দরিদ্র পরিবারের নারীদের ভুল বুঝিয়ে মনগড়া চিকিৎসা দিয়ে ডেলিভারির কাজ করে আসছেন। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দূর্ঘটনার অভিযোগও ওঠেছে তার বিরূদ্ধে। গতকাল ১৯ ডিসেম্বর রোববার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বরাবর নাসিমার বিরূদ্ধে ভুল চিকিৎসায় স্ত্রীর গর্ভের শিশু মেরে ফেলার লিখিত অভিযোগ করেছেন সৈয়দটুলা গ্রামের মো. সোহেল রহমান। অভিযোগপত্র ও সরজমিনে ঘুরে জানা যায়, নাসিমার বাড়ি কসবা উপজেলার তালতলা গ্রামে। স্বামী কুতুব মিয়া (৪৩) মাদকাসক্ত। নাসিমার পড়ালেখা নেই। নেই কোন প্রশিক্ষণও। একসময় কিছু দিন আরেক অক্ষর জ্ঞানহীন কথিত ধাত্রীর কাজে সহায়তা করতেন। সেই থেকেই নাসিমা এখন বড় ধাত্রী ও গাইনি চিকিৎসকের কাজ করছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে মাত্র ৩০-৪০ গজ দূরে ভাড়া বাসা নিয়ে নাসিমা এ কাজ করছেন। রোগী ম্যানেজ করতে নাসিমা ১২-১৪ জন নারী পুরূষ মাঠে রেখেছেন। সাধারণ মানুষের কাছে যারা দালাল হিসেবেই পরিচিত। নাসিরার প্রলোভন সিজার নয়, স্বাভাবিক (নরমাল) ডেলিভারি। আর টাকা বাঁচাতে এই ফাঁদে পড়ছেন স্বল্প শিক্ষিত অসহায় দরিদ্র পরিবারের নারীরা। ফলে মাঝে ঘটছে মা ও শিশু মৃত্যুর ঘটনা। বিভিন্ন লেভেলে মাসোহারা দিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। ওই গ্রামের লোকজন অনেক আগেই নাসিমাকে সরে যেতে বলেছিলেন। নাসিমা তা আমলে নেয়নি। গত ১৩ ডিসেম্বর সোমবার সৈয়দটুলা গ্রামের সোহেল রহমানের গর্ভবতী স্ত্রী মিলি আক্তারের (২৬) মুঠোফোনে ফোন দেন নাসিমা। বলেন আপনি আমার বাসায় চলে আসেন। আমি নরমাল ডেলিভারি করে দিব। সরল বিশ্বাসে নাসিমার বাসায় চলে যায় মিলি। মিলি ও তার স্বজনদের নাসিমা বলেন আপনার কোন চিন্তা করবেন না। অপেক্ষা করূন। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই নরমাল ডেলিভারি করে দিব। সেখানে অবস্থানকালে প্রায় ৪ ঘন্টা মিলি ও তার গর্ভের শিশু পুরোপুরি সুস্থ্য ছিল। এর কিছুক্ষণ পর নাসিমা ডেলিভারি করার চেষ্টা করেন। পরে একটি মোটা ইনজেকশন এনে মিলির শরীরে প্রয়োগ করেন। সঙ্গে সঙ্গে মিলি যন্ত্রণা ও ব্যাথায় অস্থির হয়ে পড়ে। এক ঘন্টা পর যখন ধাত্রী নাসিমা বুঝতে পারেন গর্ভের বাচ্চাটির নড়াচড়া বন্ধ। রোগীও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তখন তার বাসা থেকে রোগীকে তাড়াতাড়ি বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কোন উপায় না দেখে রোগীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন গর্ভের বাচ্চাটি জীবিত নেই। তাই মাকে বাঁচাতে হলে সিজার করতে হবে। সিজারের পর দেখা যায় পরিপূর্ণ ছেলে শিশুটি আর বেঁচে নেই। সিজারের পর সেখানে পাঁচ দিন চিকিৎসা শেষে গত ১৮ ডিসেম্বর রোববার মিলিকে রিলিজ দেন চিকিৎসকরা। সার্জন ডা: রনজিত বিশ্বাস, ওঁর সহকারি ডা: সাথী, ডা: জেসমিন ও ডা: মমতাজুল হক কেইস সামারিতে বলেন, মিলির জরায়ু ফেঁটে (ছেড়াফাঁড়া) গেছে। পেটের ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধা ছিল। ৩ কেজি ৮শত গ্রাম ওজনের একটি মৃত ছেলে শিশু ছিল। জমাট বাঁধা রক্ত ও মৃত বেবীটিকে বের করা হয়েছে। জরায়ু রিপিয়ার করা হয়েছে। ভুক্তভোগী মিলি আক্তারের শশুর মো. জিল্লুর রহমান ও স্বামী মো. সোহেল রহমান বলেন, নাসিমা ভুল চিকিৎসা দিয়ে মিলির গর্ভের শিশুটিকে মেরে ফেলেছে। সে এখানে মানুষের সাথে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করছে। আমরা এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। আর কেউ যেন তার দ্বারা এমন নির্মমতার শিকার না হয়। উচালিয়া পাড়া গ্রামের বাসিন্ধা ডা: তপজিদ দত্ত ও সাংবাদিক নারায়ণ চক্রবর্তী বলেন, নাসিমা এখানে যা করছে তা নিয়ম নীতির মধ্যে পড়ে না। সামাজিক সিদ্ধান্তে তাকে চলে যেতে বলেছিলাম। সে শুনেনি। বাড়ির মালিক সোহাগকেও বিষয়টি অবগত করেছি। অভিযুক্ত নাসিমা নিজেকে নির্দোষ দাবী করে বলেন, তারাই রোগিটিকে ক্ষতি করেছে। আমি মাত্র ৩০০ টাকা নিয়েছি। ১টি ইনজেকশন পুশ করেছি। এটি ব্যাথার নয়। আমি হাসিনা ম্যাডামের সাথে কাজ করেছি। কুমিল্লা সরকারি হাসপাতালে ৫ বছর কাজ করেছি। এখানেও ৫ বছর ধরে কাজ করছি। ৫০/৬০ গ্রামের রোগী আমার কাছে আসেন। নরমাল ডেলিভারির জন্য ৮ হাজার টাকা লাগবে। গতকাল নাসিরনগরের এক রোগির কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়েছি। আমার নরমাল ডেলিভারির বিষয়গুলো নোমান স্যারের সাথে মাঝে মধ্যে আলোচনা করি।
সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: মো. নোমান মিয়া লিখিত অভিযোগপত্র পাওয়ার কথা স্বীকার বলেন, শুধু নাসিমা নয়। এমন আরো ধাত্রী রয়েছেন। যারা এমন কাজ করছেন। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আইনগত ব্যবস্থা নিব।