জহুরুল হক মুন্সি। ১৯৭১ সালে নারায়নগঞ্জ শিপ
ইয়ার্ড এর সুপার ভাইজার পদে কর্মরত এক টগবগে যুবক। চাকুরির পাশাপাশি শিপ
ইয়ার্ডের ট্রেড ইউনিয়নের সহ-সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের
৭ মার্চে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্থানীদের জুলুম
অত্যাচার ও বৈসম্য আচরণের প্রতিবাদে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার
লক্ষে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সমাবেশ ডাকেন। সে সময় জহুরুল হক মুন্সি ওই
সমাবেশে হাজির ছিলেন। তিনি আগে থেকেই পাকিস্থানীদের বৈসম্য আচরণে
ক্ষুব্ধও ছিলেন। সে কারণে জহুরুল হক মুন্সি ৭ মার্চের আগেই ৪ মার্চ
শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকা থেকে নিজের খরচে এক ট্রাক
বাঁশের লাঠি নিয়ে ওই সমাবেশে সরবরাহ করেন। একপর্যায়ে সমাবেশ থেকে ডাক
আসে স্বাধীনতা যুদ্ধের। তিনিও প্রস্তুত হয়ে নারায়নগঞ্জ শিপ ইয়ার্ডের
৬১ জন কর্মচারিকে উদ্বুদ্ধ করে সংগ্রাম পরিষদ তথা মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে
পড়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লোখায়। যুদ্ধ শুরু হলে সেখানে
কিছুদিন যুদ্ধ করেন। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ ঢাকায় পাক সেনাদের অত্যাচারের খবর
পৌঁছতেই সেখানকার শিপ ইয়ার্ডের ডক শ্রমিক ও আনসারা মিলে স্থানীয়
ট্রেজারির অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এদেরই একজন
জহুরুল হক মুন্সী।
জহুরুল হক বলেন, যুদ্ধের শুরুতে আমাদের সম্বল ১৯৬৪ সালে নেওয়া শফিপুর
আনসার ক্যাম্পের ট্রেনিং আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের ব্যবহৃত এবং ডক
ইয়ার্ডের লুট করা প্রায় ৫০টি ৩০৩ রাইফেল। কিন্তু পাকিস্থানীদের ভারি
অস্ত্রের সামনে তো এইটুকুতে হবে না। চাই উন্নত ট্রেনিং ও অস্ত্র। তখন ঠিক
করি মুক্তাঞ্চলে যাব। যেই ভাবা সেই কাজ। ১০ এপ্রিল আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে
আড়াই হাজার যাই। এরপর ঘোড়াশাল
ফ্ল্যাগ-শফিপুর-মাওনা-টাঙ্গাইল-মধুপুর-জামালপুর এবং নিজ এলাকা
শেরপুর-বকশীগঞ্জ হয়ে কেবল মাত্র পয়ে হেটে ১৪ এপ্রিল পৌছাই ভারতের
মহেন্দ্রগঞ্জে। বকশীগঞ্জে মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বে ১১ নম্বর সেক্টর গঠন
করা হয়। সেক্টর কমান্ডার জহুরুল হককে বকশীগঞ্জ, জামালপুর ও শেরপুরের
মাইন স্থাপনের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর পরিকল্পিত বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে
জুন মাসে পাঠনো হয় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে। এই ট্রেনিং শেষে আবারও চলে আসি
মহেন্দ্রগঞ্জে। সেখান থেকে দায়িত্ব পড়ে তেলঢালার এক জঙ্গলে। জঙ্গলে
মেজর জিয়াউর রহমানের কমান্ডে প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল
রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লে.
মাহবুবুর রহমানের অধীনে গাইবান্ধার ঘাঘট নদীর ব্রীজ ধ্বংসে অংশ নেই।
জহুরুল মুন্সি বলেন, ৭ ডিসেম্বর শেরপুর যখন মুক্ত হয় তখন জামালপুরস্থ
পাক সেনাদের ক্যাম্প আত্মসমর্পণ পত্র নেয়ার জন্য লোক খোজা হচ্ছিল তখন
কেউ হাত তুলেনি। কিন্তু আমি জয় বাংলা বলে হাত তুলে বলি, আমি যাব
সারেন্ডার পত্র নিয়ে কথা মতো কাজ। ৯ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১০ টার দিকে
জামালপুস্থ পাক সেনাদের ক্যাম্পের সামনে পৌঁছামাত্রই পাকসেনারা আমাকে
ধরে ক্যাম্পের ভিতর নিয়ে ব্যপক নির্যাতন চালায়। পরে গভীর রাতে
পাকিস্থানীরা আত্মসমর্পণ করবে না এই মর্মে একটি পত্র লিখে এবং আমার
শার্টের পকেটে একটি বুলেট আকারে টাইম বোমা দিয়ে ছেড়ে দেয়। পরে আমি
জামালপুরস্থ মিত্র বাহিনীর ক্যাম্পে গিযে বিষয়টি বললে, মিত্র বাহিনী ওই
রাতেরই উপর থেকে এবং নিচ থেকে পাকিস্থানী ক্যাম্পে হামলা চালায়। পরে ১০
ডিসেম্বর জামালপুর মুক্ত হয়।
এছাড়া জহুরুল হক মুন্সি শেরপুর, জামালপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধাসহ
বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য সন্মুখযুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে অসিম সাহসের মাধ্যমে
শেষ করেছেন এবং বিজয়ীও হয়েছেন। তার এই অসীম সাহসিকতার জন্য রাষ্ট্র
তাকে দেয় বীর প্রতিক বার উপাধি বা ডবল বীর প্রতিক খেতাব। অর্থাৎ
বিশেষদুইটি অপারেশনের জন্য পৃথক দুইটি উপাধি। দেশের গণমুক্তিযোদ্ধাদের
মধ্যে তিনিই একমাত্র ডবল বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। অন্য
যারা পেয়েছেন তারা বিভিন্ন বাহীনির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে
তিনি ১১ নং সেক্টরের সাব সেক্টরের ইন্টেলিজেন্ট কমান্ডো এবং মিত্র
বাহীনির মারাঠা ফাস্ট ব্যাটেলিয়ানের ৯৫ বিগ্রেড গাইডিং অফিসার।
দুর্দান্ত সাহসী এই যোদ্ধার কিছু ঘটনা নিয়ে মেজর কামরুল ইসলাম ভূঁইয়া
বিজয়ী হয়ে ফিরবই নইলে ফিরবই না নামে একটি বই লিখেছেন। ওই বইতে জহুরুল
হক মুন্সির বীরত্বের কথা বলতে গিয়ে মেজর কামরুর হাসান ভূঁইয়ার তার
বইয়ের ৮১ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, বিগ্রেডিয়ার পানওয়ার আমাকে সেসব ছবি
দেখিয়েছেন। সশস্ত্র মুন্সী পাকিস্থানীদের লাশের স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে।
যুদ্ধবন্দী হিসেবে নেওয়া হলো ৬১ জনকে, পাকিস্তানি মৃতদেহ পাওয়া গেল
২৩৫টি এবং আহতঅবস্থায় বন্দী করা হল ২৩ জনকে। দখল করা হল বিভিন্ন ধরনের
প্রচুর অস্ত্র। জামালপুর মুক্ত হল ১০ ডিসেম্বর। মেজর জেনারেল নাগরা এবং
ব্রিগেডিয়ার ক্লেরসহ ভারতীয় সৈনিকেরা বাংলাদেশের এক প্রত্যয়ী যুবকের
দেশপ্রেম ও সাহস দেখে অবিভুত হলেন। দুইবার বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়াটা তার
জন্য কমই।
জহুরুল হক মুন্সি বর্তমানে তার নিজ বাড়িতে শেরপুরের শ্রীবরদীতে অবসরে
বসে কবিতা লিখেন, বই আর পত্র-পত্রিকা পড়ে এবং বাড়ির বিভিন্ন গৃস্থলি
কাজ করে সময় কাটান। এ ছাড়া জেলাসহ দেশের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের বিপদে
আপদে ছুটে যান তিনি, তাদের পাশে থেকে যা যা করা দরকার তাই করেন।
ডা.মোহাম্মদ শহিদুল্লার সাথে এসো মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনি কর্মসূচি নিয়ে
দেশের ১৮ টি জেলায় তিনি সফর করেছেন। বাড়ির পাশেই শ্রীবর্দী কাঁচা বাজার
সংলগ্ন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড অফিস। প্রতিদিন সেখানে তার এক বার
হলেও বসতে হবে।
জহুরুল হক মুন্সি তার দাদার বাড়ি ১৯৪৩ সালের ১ জুলাই বর্তমান শ্রীবর্দীর
পার্শ্ববর্তী বকশীগঞ্জের চন্দ্রবাজ সরকার বাড়ি জন্ম গ্রহন করেন। তিনি
বর্তমানে তার নিজ বাড়ি শ্রীবর্দী খামারিয়া পাড়ায় বসবাস করছেন। বড়
ছেলে এসএম মনিরুল হক ঢাকায় পাওয়ার গ্রীড লি: এর জুনিয়র সহকারী
ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। মেঝ ছেলে এসএম মঞ্জুরুল হক এইচএসসি পাশ করার
পর বাড়িতে থেকে বাবার সাথে সংসারের কাজ দেখা শোনা করেন। ছোট ছেলে এসএম
মিজানুল হক মিজু ঢাকায় একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন
এবং একমাত্র মেয়ে জহুরা খাতুনের পার্শ্ববর্তী কাকিলাকূড়া গ্রামের এক
ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে হয়েছে।