উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ভাঙন কবলিত খোলপেটুয়া নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন কিছুতেই থামছে না। রাতের আঁধারে বোরিং করে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। স্থানীয় ও বহিরাগত একাধিক বালু ব্যবসায়ী বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয়ের জন্য ড্রেজার মেশিনের সহায়তায় বুমপদ্ধতিতে ওই বালু উত্তোলন করছেন। উত্তোলনকৃত বালু স্থানীয় নওয়াঁবেকী বাজার ও মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থানে গুদামজাতের পাশাপাশি বিভিন্ন ঠিকাদার ও ব্যক্তির চাহিদামত সরবরাহ করা হচ্ছে।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় দীর্ঘদিন ধরে এমন কান্ড চললেও কেউ ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করছে না। বার বার ভাঙনের মুখে পড়া এলাকা হতে এভাবে অব্যাহত বালু উত্তোলন সত্ত্বেও কোন পক্ষের ন্যুনতম ভ্রুক্ষেপও নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসন এমনকি পাউবো সংশ্লিষ্টরা পর্যন্ত অজ্ঞাত কারণে নীরবতা পালন করে যাচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। অথচ দুর্যোগপ্রবন অংশ হতে টানা বালু উত্তোলনের ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে দিনকে দিন ভাঙন আতঙ্ক বেড়েই চলেছে।
উপজেলার খোলপেটুয়া নদী তীরবর্তী বিড়ালাক্ষী, পাতাখালী, পাখিমারা, সোরা ও জেলেখালী এলাকার শত শত মানুষ জানান, মাঝনদীতে একাধিক ড্রেজার মেশিন বসানো রয়েছে। ছোট ছোট কার্গো ও নৌকার মধ্যে বসানো ওই মেশিনের সহায়তায় নদীর গভীর থেকে বোরিং করে বুম পদ্ধতিতে বালু উত্তালন করা হচ্ছে। একই সময়ে পাশে অপেক্ষমাণ অপর নৌযান এবং কার্গোযোগে উত্তোলনকৃত সেই বালু নওয়াবেঁকী, ভেটখালী ও মুন্সিগঞ্জসহ অপরাপর নির্দিষ্ট গন্তব্যে নেওয়া হচ্ছে।
গ্রামবাসি জানায়, বহিরাগত ও স্থানীয় কয়েক ব্যবসায়ী খুলনা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাসমুহ থেকে ড্রেজার মেশিন আর কার্গোসহ ভাড়াটে শ্রমিক আনিয়ে নির্দিষ্ট অংকের চুক্তিতে এসব বালু উত্তোলন করছে। প্রতিদিন বিভিন্ন স্পট থেকে বুম পদ্ধতিতে বোরিং করে তারা কোটি কোটি ঘনফুট বালু উত্তোলন করছে। বার বার ভাঙনের শিকার এসব এলাকার নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে স্থানীয়দের মধ্যে নদী ভাঙনের ভীতি প্রকট হচ্ছে।
বালু উত্তোলনের কাজে জড়িত শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, উত্তোলনসহ নির্দিষ্ট গস্তব্যে পৌছে দিতে দুরত্ব ভেদে বালু ব্যবসায়ীরা তাদেরকে প্রতি ফুট চার থেকে ছয় টাকা দিচ্ছে। পরবর্তীতে ওই বালু ফুট প্রতি আট থেকে চৌদ্দ টাকায় বিক্রি করছে। বালু ব্যবসায়ীদের দেখিয়ে দেওয়া অংশ থেকে তারা ‘হুকুমের গোলাম’ হিসেবে বালু উঠিয়ে দিচ্ছে বলেও তাদের দাবি।
স্থানীয়দের দাবি ভাঙন কবলিত এলাকা হওয়ায় মানুষের দৃষ্টি এড়াতে রাতের বেলা বালু উত্তোলন করছে সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় তহশীল অফিস, ঊর্ধ্বতন প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিরা অজ্ঞাত কারণে চুপ থাকায় মাসের পর মাস ধরে তারা বালু উত্তোলন অব্যাহত রেখেছেন।
স্থানীয়রা জানান, বালু উত্তোলনের সাথে জড়িতরা এলাকায় প্রভাবশালী হওয়াতে তারা কারও নাম মুখে আনতে চায় না। তবে এভাবে ভাঙন মুখে থাকা এলাকা থেকে অব্যাহতভাবে বোরিং করে বালু উত্তোলনের ঘটনায় তারা শংকিত বলে জানান।
বিড়ালাক্ষী গ্রামের আলমগীর হোসেন ও সামছুর রহমান জানান, আইলার পর থেকে গত এক যুগে অন্তত আটবার তাদের বসতবাড়ি সংলগ্ন উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নদীর চর ডেবে যাওয়াসহ সম্প্রতি বোরিং করে বালু উত্তোলন শুরু হওয়ায় তারা চরম ভাঙন আতংকের মধ্যে পড়েছেন।
পাখিমারা গ্রামের অজয় মন্ডল জানান, পাশের আশাশুনি উপজেলার জেলেখালী এলাকার চরকে দুই বছর আগে বালুমহাল ঘোষনা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার জন্য দুরবর্তী এলাকায় না যেয়ে যত্রতত্র ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে বালু উত্তোলন করছে। বার বার ভাঙনের মুখে পড়া এসব এলাকা থেকে অব্যাহতভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন কোন উদ্যোগ নেয় না বলে তার অভিযোগ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন জানায় নওয়াবেঁকীর ফারুক, বিড়ালাক্ষীর হাসান ও জাহাঙ্গীরনহ গাবুরার সাইফুল এবং মুন্সিগঞ্জের ফেরদাউস হোসেন বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত। ভাড়াটে শ্রমিক দিয়ে নদী থেকে বোরিং করে বালু উত্তোলনের পর তারা নিজেদের আড়তে গুদামজাতের পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে তা সরবরাহ করছে। তারা আরও জানায় ফারুক ও জাহাঙ্গীরসহ কিছু ব্যবসায়ী একাধিক কার্গো ও ড্রেজার মেশিনসহ নিজস্ব সরঞ্জাম দিয়ে লাগাতার খোলপেটুয়া নদী থেকে দীর্ঘমেয়াদে বালু উত্তোলন করছে। জনপ্রতিনিধিসহ জনপ্রশাসনকে নানাভাবে ‘ম্যানেজ’ করে তারা দীর্ঘদিন ধরে ভাঙনকুল থেকে বাধাহীনভাবে বালু উত্তোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলেও তাদের দাবি।
আনিছুজ্জামান সুমনসহ স্থানীয় কয়েক গ্রামবাসী জানায় নওয়াবেঁকী ও ভেটখালীসহ মুন্সিগঞ্জ বাসষ্ট্যান্ড এলাকার গুদামসমুহের যাবতীয় বালু ভাঙন কবলিত খোলপেটুয়া নদী থেকে বোরিং করে উত্তোলনকৃত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও কতৃপক্ষের হাতে থেকে ব্যবসা নির্বিঘœ রাখতে এসব গুদামের বালু জেলেখালীর চরের বলে তারা প্রচারানা চালিয়ে থাকে। মুলত খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদী থেকে অবৈধভাবে উত্তোলনকৃত বালু এসব অংশে গুদামজাত করে দিব্যি ব্যবসা করে যাচ্ছে বলে তাদের দাবি।
বালু উত্তোলনের বিষয়ে প্রধান অভিযুক্ত মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বালু আড়তের মালিক ফেরদাউস হোসেন জানান, আমি নিজে বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত না। যারা উত্তোলন করে তাদের থেকে আমি কিনে নিয়ে খুচরা বিক্রি করি। কোথা থেকে আর কিভাবে তারা উত্তোলন করছে তা আমার জানা নেই।
বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত কার্গোসহ যাবতীয় সরঞ্জাম নিজের নিশ্চিত করে নওয়াবেঁকীর ফারুক হোসেন জানান, সাতক্ষীরার এক ব্যবসায়ী ডাকে নেয়া খোলপেটুয়া নদীর চর থেকে বালু উত্তালনের কাজ তাকে দিয়েছে। তার নওয়াবেঁকী গুদামের বালু ভাঙন কবলিত এলাকা থেকে সংগৃহীত নয় বলেও তিনি দাবি করেন।
বালু উত্তোলনের কাজের সাথে জড়িত কালিকাপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান বলেন, প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। দূরবর্তী বালুমহালের অনুমতি থাকলেও যত্রতত্র বোরিং করে বালু উত্তোলন করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
তবে স্থানীয়দের দাবি সাতক্ষীরার আশাশুনির চর বালু মহাল ঘোষনা সত্ত্বেও অধিক মুনাফার লোভে প্রভাবশালীরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ভাঙন কবলতি খোলপেটুয়া নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের শেখানো বুলি আওড়িয়ে এসব ব্যবসায়ী ভাঙন কবলিত এলাকার বালুকে বালু বহালের বলে চালিয়ে দিচ্ছে।
এবিষয়ে পরিবেশ আন্দোলন কর্মী আবদুল হালিম জানান, নদী ভাঙনের ফলে প্রতি বছর শ্যামনগরের উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। তারপরও পাশের নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করা না হলে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরী উপকূল রক্ষা বাঁধ কোনভাবেই টিকবে না।
‘বোরিং করে বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখতে হবে’-উল্লেখ করে সহকারী অধ্যাপক দেবাশীষ মিস্ত্রি জানান, বালুমহালের বাইরে অন্য যে কোন জায়গা থেকে বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। ভাঙন রোধের জন্য নদীর চরে গাছ লাগানোর পাশাপাশি যত্রতত্র বালু উত্তোলন ঠেকাতে হবে।