কিশোরগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত অঞ্চলে ভুর্তকির আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষকরা স্বাবলম্বী হচ্ছে। প্রযুক্তির এই যুগে কৃষিখাতে বিপ্লব ঘটেছে। ফলে দেশের কৃষি সেক্টরের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি যন্ত্র শিল্প ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে।
নতুন নতুন উদ্যেক্তার সৃষ্ঠি হয়েছে। কৃষিখাতের সফলতায় ভাগ্য খুলে গেছে কৃষকদের। অতীতে যখন লাঙল-জোয়াল আর ‘হালের বলদ’ ছিল কৃষকের চাষাবাদের মূল উপকরণ সে জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে আধুনিক কৃষি যান্ত্রিকরন। এখন সনাতন যন্ত্রাপাতি হিসেবে লাঙল-জোয়ালকে প্রদর্শন করা হয় উন্নয়ন মেলায়।
কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আয়তন ১৪.৮৬ মিলিয়ন হেক্টর, যার প্রায় ৮.৫২ মিলিয়ন হেক্টর জমি চাষাবাদে ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ আসে কৃষি খাত থেকে। ধান, গম ও ভুট্টা এ দেশের উল্লেখযোগ্য খাদ্যশস্য। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৮ সালের তথ্য অনুসারে প্রধান খাদ্যশস্য ধানের উৎপাদন প্রায় ৫৩.৬ মিলিয়ন টন।
কৃষি কাজে খরচ ও সময় বাঁচাতে এবং অধিক লাভ করতে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারের বিকল্প নেই। কৃষি কাজে সবচেয়ে শ্রম ও সময় নির্ভর কাজ হচ্ছে চারা রোপণ, বীজ বপণ ও ফসল কর্তন। এ কাজগুলো সঠিক সময়ে করতে পারলে কৃষক লাভবান হবে।
বর্তমান সরকার কৃষি বান্ধব সরকার। হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যায় ধান ঘরে তুলতে ও শ্রমিক দৌরাত্মা রোধে কৃষি আধুনিকরনে ধান কাটায় কম্বাইন্ড হাভেস্টার যন্ত্র কৃষিতে হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। অথ্যাধুনিক প্রযুক্তির এ যন্ত্রটা অনেকটা ট্রাক্টরের মত দেখতে। এ যন্ত্র দিয়ে একই সাথে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তায় ভরা যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ কমানো যায়। যন্ত্রটি ব্যবহার করলে সময় বাঁচায় ৭০-৮২ শতাংশ এবং ৭৫ শতাংশ কম শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে এক একর জমির ধান বা গম কাটতে খরচ হয় প্রায় আট হাজার টাকা। সেখানে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহারে লাগে মাত্র ৪০০০-৪৫০০ টাকা। এটি অল্প কাদার মধ্যেও ব্যবহার করা যায়। একই সঙ্গে এ যন্ত্র দিয়ে ফসল কাটার পর খড়ও আস্ত থাকে। হাওর অঞ্চল ও উপকুলীয় এলাকায় ৭০% এবং অন্যান্য এলাকায় ৫০% ভুর্তুকিতে সরকার কৃষি মন্ত্রনালয়ের আওতায় বৃষকদের মাঝে এ যন্ত্র সরবরাহ করছে।
কিশোরগঞ্জ জেলা সদর উপজেলায় ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১৩ টি ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮টি হার্ভেস্টার মেশিন কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা হয়েছে। সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে একমাত্র দানাপাটুলী ইউনিয়ন হাওর অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে ভুর্তকির পরিমান ৭০% হওয়ায় ধান কাটার হার্ভেস্টার যন্ত্র নিতে কৃষকদের মধ্যে সাড়া পড়ছে বেশী। উপজেলা কৃষি অফিসের এক সমিক্ষায় জানা যায় ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১৩টি যন্ত্রটি নিতে ২৩ জন কৃষক আবেদন করেন উপজেলা কৃষি অফিসে। এর মধ্যে বেশীর ভাগ ১২টি আবেদন পড়ে দানাপাটুলী ইউনিয়ন হতে। আবেদনের ভিত্তিতে উপজেলা কৃষি পূনর্বাসন কমিটি ও প্রকল্প পরিচালক, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প, কর্তৃক অনুমতিক্রমে ১২টি যন্ত্র দানাপাটুলী ইউনিয়নে এবং একটি যন্ত্র পৌরসভায় বিতরন করা হয়। বাকি আবেদনকারীগন তালিকা অনুমোদন পেলেও যন্ত্র নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৮টি যন্ত্র বরাদ্দ পাওয়া যায়। ৬টি দানাপাটুলী ১টি মারিয়া ও ১টি চৌদ্দশত ইউনিয়নে বরাদ্দ প্রাপ্য হয়। এ অর্থ বছরে ৮টি যন্ত্র নিতে ২৭টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে জানা যায় এ বছরেও সিংহভাগ ২১ জন আবেদন করেন দানাপাটুলী ইউনিয়ন থেকে। ৬টি আবেদন করা হয় অন্যান্য ইউনিয়ন থেকে। তবে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় অন্যান্য ইউনিয়নের আবেদনকারীর নামে যন্ত্র বরাদ্দ হলেও পরে তারা যন্ত্র নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
সদর উপজেরা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলা কৃষি অফিসের সাথে ৩০০ শত টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে উভয় পক্ষের অঙ্গিকার মূলক তিন বছরের মধ্যে যন্ত্রটি অন্যত্র বিক্রয় কিংবা হস্তান্তর করা যাবেনা চুক্তি করা হয়। কেহ এ চুক্তি পত্রের বিধান লংঘন করলে তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ তদন্ত পূর্বক যে কোন প্রকার আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারবেন। সূত্রে আরো জানা যায়, একই পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন কৃষক ও সঠিক উদ্যেক্তা হলেও যন্ত্র সরবরাহ করতে কোন বাধাঁ নেই।
এদিকে দানাপাটুলী ইউনিয়নে ভুক্তভোগী যন্ত্র মালিকদের হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্থ করার তীব্র অভিযোগ উঠছে। সরেজমিনে গিয়ে তাদের সাথে কথা হলে তারা জানান, একটি চক্র উদ্দেশ্যে প্রনোদিত হয়ে তাদের নামে মেশিন বিক্রয় এমনকি মিথ্যা ও কাল্পনিক কাহিনি সাজিয়ে কর্তৃপক্ষের নিকট একের পর এক অভিযোগ দায়ের করছে। ভুক্তভোগী এসকল লোকজন আরো জানান, ভুর্তকির টাকা বাদে ও বাদ বাকী টাকা মেশিন দিয়ে কামাই করে নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের পরিশোধ করতে হবে। তাই আমরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাত দিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ধান কেটে টাকা সংগ্রহ করি। প্রতিনিয়ত ধান কাটার মৌসুমে শীত, গ্রীস্ম ও বর্ষা উপেক্ষা করে জীবন যুদ্ধে লড়াই করছি। অর্থনৈতিক চাকা ঘুরাতে নিজেকে ও পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে।
এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ জামাল উদ্দিনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, সরকারী নীতি মালা অনুযায়ী আগ্রহী প্রকৃত কৃষকদের মাঝে যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। তবে যন্ত্র বিক্রয় করার বিষয়ে এমন আপত্তিকর দু’একটি লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরপরই আমি দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করি। এমনকি দানাপাটুলী ইউনিয়নের কতক লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে ১৬টি যন্ত্র স্ব স্ব কৃষকের জিম্মায় দেখতে পাই। আর দুটি যন্ত্র অন্যত্র আমন ধান কাটার কাজে ব্যস্ত আছে। তবে ভুক্তভোগী যন্ত্র মালিক কাজ শেষ হলে দু’তিন দিনের মধ্যে নিজ বাড়িতে যন্ত্র নিয়ে আসবে বলে এলাকাবাসীর সামনে আমাকে জানান। তবে যন্ত্র বিক্রয় বা হস্তান্তর করার বিষয়টি আদৌ সত্য নহে।