পৃথিবীর কোনো দেশেই বাংলাদেশের মতো বাসের চাকার তলায় এত সংখ্যক বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রাণ হারায় না। সে জন্য এদিকটি একেবারে বন্ধ করা প্রয়োজন দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে। এর জন্য প্রয়োজন সাধারণ মানুষ, বাসের মালিক, ড্রাইভার ও সরকারের সহযোগিতা। একটা দিক চিন্তা করে দেখা প্রয়োজন, অপরাধের শাস্তি না হলে রাস্তার অপরাধ কোনোদিন বন্ধ হবে না।
পথ, রাজপথ, হাইওয়ে মানুষ ও যানবাহনের চলার পথ এবং এই কারণে মানুষও যন্ত্রযানের মধ্যে একটা সম্পর্ক বিদ্যমান। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এই কারণে উভয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক বিদ্যমান আর এই সখ্যতা পরস্পর বিরুদ্ধ নয়। এই সখ্যতা মানুষের সঙ্গে যন্ত্রযান ও মানুষের সঙ্গে মানুষের। কারণ, যে মানুষ যানবাহন চালায় আর যে সব মানুষ রাস্তা ব্যবহার করে তারা একই গোত্রের। কিন্তু বাংলাদেশের পথে ও রাজপথের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এর বিপরীত চিত্রই লক্ষ্য করা যায়। এখানে পথচারী মানুষের শত্রম্ন যানবাহন ও যন্ত্রযান চালিত মানুষ। বাংলাদেশে এই বিরুদ্ধ সম্পর্কের কারণ পথ ও রাজপথের আকৃতিগত গঠনের খানিকটা পরিবর্তিত রূপ ও গাড়ি চালকের অজ্ঞানতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরনো যানবাহনের ব্যবহার। এর সঙ্গে রাস্তায় চলমান মানুষের অসতর্কতাও খানিকটা দায়ী। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাস্তায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে একসময় সুদক্ষ বাসচালকের অভাব ছিল না। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঢাকাতেই বেশি সিটি বাস নাগরিক পরিবহণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো এবং পরে প্রাইভেট বাস পরিবহণের পাশাপাশি বিআরটিসি অন্তর্ভুক্ত হয় শহর ও পরবর্তী পর্যায়ে আন্তঃনগর পর্যায়ে। পরবর্তীতে এই পথ প্রসারিত হয় ঢাকা-কলকাতা রুটে। সাধারণ বাসের তুলনায় বিআরটিসির গাড়িচালকরা ছিলেন বেশি অভিজ্ঞ এবং সেবাও ছিল মানসম্মত। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে ঢাকার বেসরকারি পরিবহণে চলাচলের সময় নিয়ন্ত্রণে একটা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। নগরের একপ্রান্ত থেকে শেষ পয়েন্টে পৌঁছানোর আগে কয়েকটি পয়েন্টে বাস ঠিক সময়ে পৌঁছেছে কিনা দেখার জন্য অপেক্ষমাণ কর্মকর্তার কাছে বাসের সহকারীকে ছুটে গিয়ে পৌঁছানোর সময় লিখিয়ে আসতে হতো এবং নির্দিষ্ট সময়ের বেশি হলে জরিমানা দিতে হতো। এর ফলে বাস পরিচালককে সাবধানে বাস চালানো ছাড়াও বাস থামার জায়গা ছাড়া রাস্তার যেখান-সেখান থেকে যাত্রী তোলা যেত না। শুধু তাই নয়- দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া নিয়ে কনডাক্টর টিকিট দিতেন। আলোচ্য পর্বে ঢাকায় বাসের তলায় পিষ্ট হওয়ার ঘটনা ছিল কল্পনার বাইরে। এমনকি, রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচলের সময় বাসের ধাক্কা দেওয়ার ঘটনাও চোখে পড়ত না। অবশ্য, একটি দিক এখানে লক্ষণীয়, তখন ঢাকায় বর্তমানের মতো লোকসংখ্যার এত বৃদ্ধি হয়নি, লোকজনও রাস্তার দু'পাশ দিয়ে পথ চলতেন এবং রাস্তার পাশে এত দোকানপাটও হয়নি।
পরবর্তীতে ঢাকার সম্প্রসারণকালে জীবনযাত্রার সঙ্গে যানবাহন চলাচলেও অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি চালকের সংখ্যাও বেড়ে যায়। এখান থেকেই শুরু হয় অল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত চালকের হাতে গাড়ি চালানোর ভার। অতিরিক্ত গাড়ি চলাচলের কারণে রাস্তার পক্ষেও ভার বহন করা খানিকটা কঠিন হয়ে পড়ে। রাস্তার এই অবস্থা দেশের অনেক অংশেই স্পষ্ট হয়ে উঠলেও সর্বত্র পরিচর্যার অভাবও দেখা যায় না, তা নয়। এখানে কতকগুলো দিক বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
যাত্রী সংখ্যার অনুপাতে বাস কম থাকায় অনেকেই কোনোমতে অকেজো বাস ঠিক করার পর রং দিয়ে নতুন পরিচ্ছদ পরিয়ে রাস্তায় নামানো হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাস নিয়ন্ত্রণে বিঘœও দেখা দিতে থাকে। এর ফলে বাস দুর্ঘটনা নিয়মিত না হলেও মাঝেমধ্যে ঘটতে দেখা যায়। আরও একটা বিশৃঙ্খল দৃশ্য চোখে পড়ে। সাধারণভাবে বাস চলাচলের লেন বাঁদিকে থাকলেও প্রায় সারাক্ষণই লক্ষ্য করা যায়, বিভিন্ন বাস দ্রম্নত বা আগে যাওয়ার জন্য অনবরত লেন পরিবর্তন করে এবং বলা যায়, আজ পর্যন্ত বাসচালকদের মনোভাব বিন্দুমাত্র বদলায়নি। এর ফলে বাসের এই অনিয়মে ঢাকার রাজপথে প্রত্যেক দিন যানজট একটা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে রাস্তায় মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনার চিত্রও চোখে পড়তে থাকে। শুধু একটা বাস অন্য বাসকে ধাক্কা মারা নয়, সিএনজি অথবা অন্য যানকেও ধাক্কা মেরে দুর্ঘটনার জন্ম নেয়। শুধু তাই নয়, বাসচালক নিয়মকে তোয়াক্কা না করে বাস চালানোর সময় প্রকাশ্যেই ধূমপান করলেও তা প্রতিকারের কেউ থাকে না। আগে বাসচালক অন্য বাসকে আঘাত করত কিংবা রাস্তার পাশে পড়ে যাত্রীদের আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনার জন্ম নিত। আকস্মিকভাবেই বাসের চাকার তলায় মানুষ প্রাণ হারাতে থাকে। পুরুষ, নারী-এমনকি ছাত্রছাত্রীদেরও জীবনে কালো ছায়া নেমে আসে। এই কারণেই বাসের চাকায় একাধিকবার ছাত্রছাত্রীর জীবনাবসান ঘটনার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ ও প্রতিকার- এই দুটি দিক সামনে নিয়ে রাস্তায় নেমে পুলিশের পরিবর্তে নিজেরাই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ভার গ্রহণ করে। তারা বহু বাস ও গাড়ির চালকদের যে লাইসেন্স নেই তা চোখের সামনে তুলে ধরে। কীভাবে নিজেদের লেনে গাড়ি চালাতে হবে তাও তারা দেখিয়ে দিতে থাকে।
রাস্তায় বাস দুর্ঘটনার প্রতিকার করা সম্ভব নয়, তা নয়। এ ক্ষেত্রে যে দিকগুলো মান্য করা উচিত তা এখানে নির্দেশ করা যেতে পারে।
এক. ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল করতে না দেওয়া।
দুই. বাস ও গাড়িচালকদের লাইসেন্স না থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
তিন. অদক্ষ বাসচালকদের অপসারণ করা।
চার. বাসচালক যাতে ঘন ঘন লেন পরিবর্তন না করে তা দেখে আইন অমান্যকারীদের চিহ্নিত করে জরিমানা করা।
পাঁচ. বাসচালক কোনো অবস্থাতেই গাড়ি চালানোর সময় ধূমপান নিষিদ্ধ করা ও তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। উপরের দিকগুলোর বাস্তবায়নে সরকারি কর্তৃপক্ষ ও ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব বেশি। ট্রাফিক পুলিশ নির্দিষ্ট পয়েন্টে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও অন্য একশ্রেণির ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত থাকবেন ভ্রাম্যমাণ পুলিশ। তারা মোটরসাইকেলে চড়ে সর্বক্ষণ রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আইন লঙ্ঘনকারী গাড়ির চালকদের চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
শুধু গাড়ি ও গাড়িচালক নয়, রাস্তায় দুর্ঘটনারোধে পথ চলাচলকারীদেরও দায়িত্ব আছে। পথচারীরা নিজেদের ইচ্ছামতো রাস্তায় চলাচল করলে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা। এজন্য রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটা প্রয়োজন এবং গাড়ি চলাচলের সময় কিছুতেই রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে। বিদেশেও সমশ্রেণির ব্যবস্থা আছে। লাল বাতি জ¦লার পর রাস্তা পারাপার নিষিদ্ধ এবং অমান্যকারীদের পাঁচ আইনে অভিযুক্ত করা হয়্ আমাদের দেশে পথ চলাচলে অসুবিধা হয় রাস্তার দু'পাশে ফুটপাথ না থাকায়। ব্রিটিশরা এদেশ শাসন করার সময় এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে কলকাতার সর্বত্র রাস্তার দু'পাশে ফুটপাথ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এখনো এই ফুটপাথ থাকার পথ চলাচলকারীদের গাড়ির ধাক্কা খেতে হয় না। আমাদের দেশে অনেকের মধ্যে শৃঙ্খলা না থাকায় রাস্তা চলাচলে বিঘœ ঘটে থাকে।
গাড়ি দুর্ঘটনার পেছনে আরও একটা দিক লক্ষ্য করা প্রয়োজন। রাস্তা-ঘাট ভালো নাহলে যে কোনো সময়ে দুর্ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। এ দেশে রাস্তা যেভাবে নির্মাণ করা হয় তা কিছুদিনের মধ্যেই আগের রূপ হারিয়ে ফেলে এবং অসমান ও গর্ত দেখা দেয়। রাস্তা নষ্ট হলেও তা দ্রম্নত সংস্কার করা হয় না। এর ফলে শুধু গাড়ি চলাচল নয়, মানুষ চলাচলেও অসুবিধে হয়। ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় মাঝেমধ্যে রাস্তার কারণে ধাক্কা খেতে হয়, অথচ রাজধানীর রাজপথ এমন হওয়ার কারণ নয়। এই দিকের দায়িত্ব সরকারি কর্তৃপক্ষের।
আরও একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হলে রাস্তায় বাস চলাচল নির্বিঘœ হতে পারে। প্রথমেই প্রয়োজন রাস্তায় বিভিন্ন মালিকদের বাস না নামিয়ে সরকারি উদ্যোগে এককভাবে বাস চালানো যায় কিনা তা পর্যালোচনা করে বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ। বর্তমানে যে সব বাস মালিকদের বাস চলছে তারা ইনভেস্ট করে মাসে মাসে নিজেদের মুনাফা পাবেন। বাংলাদেশ ও ভারতে বাস চলাচল করছে ব্রিটিশ প্রথায় আর আমেরিকা ও কানাডা আমাদের প্রস্তাবিত প্রথায়।
বাস দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। বাংলাদেশে বড় বড় শহরে যেখানে বাস চলে সেখানে বাসচালকরা রাস্তার যেখানে-সেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষ হাত তুললেই তাদের ভেতরে তুলে নেয়। এই অবৈধ প্রক্রিয়া অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। রাস্তার সর্বত্র বাস থামিয়ে বাস না নামিয়ে যেখানে বাসস্টপ সেখানেই বাসে যাত্রী তুলতে হবে। যাত্রীরা আগে টিকিট কেটে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবেন এবং বাস এলে লাইন না ভেঙে বাসে ওঠা প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা শৃঙ্খলা বিদ্যমান। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যাতে নারীদের প্রথমে নির্বিঘেœ বাসে ওঠার সুযোগ থাকে।
পৃথিবীর কোনো দেশেই বাংলাদেশের মতো বাসের চাকার তলায় এত সংখ্যক বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রাণ হারায় না। সে জন্য এদিকটি একেবারে বন্ধ করা প্রয়োজন দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে। এর জন্য প্রয়োজন সাধারণ মানুষ, বাসের মালিক, ড্রাইভার ও সরকারের সহযোগিতা। একটা দিক চিন্তা করে দেখা প্রয়োজন, অপরাধের শাস্তি না হলে রাস্তার অপরাধ কোনোদিন বন্ধ হবে না।
ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ : কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক