গত ২৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ঝালকাঠির কাছে সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০এ আগুন লেগে ৩৮জন মারা গেছেন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮৫জন। আর ৫১জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। চিকিৎসাধীন ৮৫ জনের মধ্যে ১৫ জনের কণ্ঠনালী আগুনে ঝলসে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। মনে করা হচ্ছে, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। সড়ক পথের সাথে পাল্লা দিয়ে ইদানীং নৌপথে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছ। সড়ক পথে যেমন অদক্ষ চালক দুর্ঘটনা ঘটছে একই ভাবে নৌপথেও চালকের পরিবর্তে অদক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে লঞ্চ চালিয়ে মানুষকে মৃত্যু ঝুঁকিতে ফেলছে। অভিযান-১০ আগুনে পুড়ে যাবার পর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি সূত্রে প্রকাশ,কাগজে কলমে লঞ্চটি যে মাস্টারের চালানোর কথা ছিল,তিনি চালাচ্ছিলেন না। মালিক ইচ্ছে করলে লঞ্চের মাস্টার পরিবর্তন করতে পারেন,তবে তা অবশ্যই নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে অবহিত করতে হবে। এখানে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। অভিযান-১০ লঞ্চের চারজন মাস্টার ও ড্রাইভারের মধ্যে তিনজনের নিয়োগের বিষয়টি লঞ্চ মালিক অধিদপ্তরকে অবহিত করেন নি। অন্য একজন লঞ্চ চালাচ্ছিলেন এবং অগ্নিকান্ডের কবলে পড়েন।
শুধু তাই নয়,অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক অনুমতি না নিয়ে লঞ্চের ইঞ্জিন পরিবর্তন করেন। আগে এ লঞ্চে ৫৫০ হর্স-পাওয়ারের দু’টি ইঞ্জিন থাকলেও তা পাল্টিয়ে ৭২০ হর্স-পাওয়ারের দু’টি ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে। অথচ বিষয়টি নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে অবগত করার প্রয়োজন মনে করেন নি। রাজধানীর সদরঘাট থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন গন্তব্যে ২২১টি লঞ্চের যাত্রী পরিবহনের অনুমতি আছে। প্রতিদিন গড়ে ৮৫টি লঞ্চ সদরঘাঠ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। কিন্তু লঞ্চগুলোর ক’টির ফিটনেস সার্টিফিকেট বা ক’টা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ জীবন রক্ষাকারী বয়া (পানিতে ভেসে থাকার সরঞ্জাম) আছে তা দেখভাল করার প্রতি কারো আগ্রহ নাই। আভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ সেগুলো দেখেও না দেখার ভান করে কেন,তা তারাই জানেন।
২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অভিযান-১০ সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাবা আগে আভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ যে’চেক লিস্ট’ তৈরি করেছিল তাতে বলা হয় লঞ্চটিতে কোনও ত্রুটি নাই। চেক লিস্ট অনুসারে,লঞ্চের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা দিনে ৭৫০জন এবং রাতে ৪২০জন। লঞ্চ ছাড়ার সময় তাতে ৩১০জন যাত্রী থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবে যাত্রী ছিলো অনেক বেশী। লঞ্চে ১২৫টি বয়া এবং ২০টি অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র থাকার কথা বলা হলেও আগুন লাগার পর সেগুলো একটিও ব্যাবহার হতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে তদন্ত কমিটি বলছে,লঞ্চের ইঞ্জিনে ত্রুটি ছিল এবং প্রাথমিক ভাবে ধারনা করা হচ্ছে ইঞ্জিন রুম থেকেই আগুনের সূত্রপাত। সংগত:কারনে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক,কেন এবং কিসের ভিত্তিতে লঞ্চ ছাড়ার আগে বলা হোলো কোনো ত্রুটি নেই। এমন মনগড়া চেক লিস্টের নিয়ম রক্ষা না করলে কি নয়?
সদরঘাট টার্মিনালে কর্মরত আভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদের জন্য অগ্নি-মহড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। লঞ্চ-মালিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে লঞ্চ-কর্মীরাও এ মহড়ায় অংশ নিতে পারেন। কিন্তু গত দু’বছরে ঢাকা-বরিশাল চলাচলকারী একমাত্র এমভি মানাসী ছাড়া কেউ এ প্রশিক্ষণ নেয় নি বা আবেদন করেন নি। ফলে মহড়ায় কারো অংশ গ্রহণও সম্ভব হয়নি। আশা করা যায় আগামীতে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলে সচেতন হবেন। এ পর্যন্ত যতগুলো লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে এবংযত প্রাণহানী ঘটেছে,তার প্রত্যেকটির কারণ ও সংশ্লিষ্ট দোষী ব্যাকিতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য,একটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টও আলোর মুখ দেখে নি। এবারো যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আশা করি এবার তদন্তের ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। নইলে এভাবেই একের পর এক প্রাণহানী ঘটতে থাকবে।