সরাইলে সাব-রেজিষ্ট্রার অফিস চলছে ডেপুটেশন কর্মকর্তা দিয়ে। সপ্তাহে কাজ চলে মাত্র ১ দিন। কারণ একই কর্মকর্তা কাজ করছেন আরো দুই উপজেলায়। ফলে দলিল নিবন্ধনের জন্য লেখকদের অপেক্ষা করতে হয় ৬ দিন। লেগে যায় জট। সিরিয়ালের প্রতিযোগিতায় ঘাম ঝরে লেখকদের। সহ¯্রাধিক ক্রেতা বিক্রেতার ভীর থাকে অফিসের বাহিরে ও ভেতরে। ধূঁলো বালি রূদ্র উপেক্ষা করে অপেক্ষমান নারী পুরূষের দীর্ঘশ্বাস। শিশুদের কান্না ও চিৎকার। বৃদ্ধ ও অসুস্থ লোকজনের আহাজারি। সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এখানকার লেখক জায়গা জমির ক্রেতা বিক্রেতাদের সীমাহীন দূর্ভোগের এমন চিত্র এখন নিয়মিত। গত তিন সপ্তাহ ধরে এভাবেই চলছে সরাইল সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসের নিবন্ধন কার্যক্রম। অথচ এ খাত থেকেই সরাইলে সরকারের রাজস্ব আসছে বছরে ১০-১২ কোটি টাকা। স্থানীয় দলিল লেখক ও ক্রেতা-বিক্রেতারা এ অবস্থা থেকে দ্রƒত পরিত্রাণ চান।
সরজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, সরাইলে প্রতি সপ্তাহে দলিল রেজিষ্ট্রি হয় প্রায় ৩ শত। তখন সপ্তাহে কাজ হত ৩ দিন। বিকাল ৪টার মধ্যেই শেষ হয়ে যেত দলিল নিবন্ধনের কাজ। গত দেড় মাস আগে বদলি হয়ে যান সাব-রেজিষ্ট্রার শেখ মো. মছিউল ইসলাম। ডেপুটেশনে আসেন আশুগঞ্জ উপজেলার সাব-রেজিষ্ট্রার ফরিদা আক্তার। তিনি সপ্তাহে বসতেন ২ দিন। স্থানীয় কতিপয় দলিল লেখকের অসৌজন্যমূলক আচরণে তিনি বিব্রতবোধ করেন। নবীনগর উপজেলার সাব-রেজিষ্ট্রার আবদুল কাদিরকে ডেপুটেশনে দেওয়া হয় সরাইলে। তিনি সরাইলে সপ্তাহে মাত্র ১ দিন (বৃহস্পতিবার) কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তিনি সপ্তাহের প্রথম ২ দিন নবীনগরে, ২ দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে উপজেলায় কাজ করছেন। ডেপুটেশনের চাপে তিনিও কাহিল হয়ে পড়েছেন। সরাইলে তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টা থেকে শুরূ করেন কাজ। চলে রাত ৯টা/ ১০টা পর্যন্ত। দলিলের খুঁটিনাটি অনেককিছু দেখে নিশ্চিত হয়ে নিবন্ধন করার নির্দেশনা থাকায় সময় লাগে অনেক। সেই কারণে অফিসের ভিতরে ও বাহিরে সহ¯্রাধিক নারী পুরূষের ভীর জমে। ভেতরে সিরিয়াল পেতে ঘাম ঝরাতে হয় লেখকদের। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে আসা বৃদ্ধ অসুস্থ লোকজনের কষ্টের শব্দ ও চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। মাঝে মধ্যে স্বস্ব লেখককে গালমন্দও করতে শুনা যায়। তারপরও ১০-১১ ঘন্টায় প্রায় দুই থেকে আড়াই শতাধিক দলিল রেজিষ্ট্রি করছেন তিনি। গত শুক্রবার বিকেলে দেখা যায় অনেক লোকের ভীর। কেউ জায়গার ক্রেতা। কেউ বিক্রেতা। বাহিরে অপেক্ষা করছেন তারা। প্রধান ফটকে তালা। পাহাড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন। ভেতর থেকে ডাকের অপেক্ষায় আছেন নারী পুরূষরা। কাঙ্খিত সেই ডাকটি যেন সোনার হরিণ। যার ডাক আসে তিনি লাফিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছেন। মাটিতে দেওয়ালে ও ঘাসের উপর বসে আছেন ভিন্ন বয়সের নারীরা। অনেকের চোখে পানি। দুপুরে ভাত নয়, নাস্তা খেয়েছেন। বাড়িতে কান্না করছে শিশু বাচ্চারা। আর কুলের বাচ্চাটিও চিৎকার করছে। এমন দৃশ্য দেখার প্রত্যাশা কেউ করেন না। তারপরও গত ৩ সপ্তাহ ধরে সরাইল সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসের সামনে এমন দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। পাকশিমুল ইউনিয়নের পরমানন্দপুর গ্রামের জুলেখা বেগম (৪২), পানিশ্বর ইউনিয়নের টিঘর গ্রামের হাফেজা বেগম (৪০), শাহজাদাপুর গ্রামের রিনা বেগম (৩৭) ও ফিরোজা বেগম (৩৮) বলেন, দলিলের কাজে এমন কষ্ট জীবনেও করিনি। সকালে এসেছি। এখন রাত ৭টা বাজে। দুপুরে ভাতও খায়নি। কখন যে ডাকবেন তাও জানি না। লেখককে মারতে ইচ্ছে করছে। টিঘর গ্রামের সোলেমান মিয়া (৫৫) বলেন, না খেয়ে ১০ ঘন্টা ধরে ঘাসের উপর বসে আছি। কেউ ডাক দেয় না। চলেও যেতে পারছি না। সরকারের লোক কম থাকলে আমাদেরকে এভাবে কষ্ট দিতে হবে। আমাদের কি দোষ? সরাইল উপজেলা দলিল লেখক সমিতির সভাপতি সৈয়দ আলী আবদাল বলেন, কি যে কষ্টে আছি বলে শেষ করতে পারব না। অথচ এ খাত থেকে শুধু গত এক বছরে সরাইলে সরকারের আয় হয়েছে ১২ কোটি টাকা। সপ্তাহে ৩ শতাধিক দলিল হয় এখানে। ডেপুটেশন রোগ ছাড়ছে না আমাদের। এরপর আছে ব্যাংকের ডিষ্টার্ব। বুধবারে পে-অর্ডার করতে পারলে কষ্ট কিছুটা হলেও কমে যেত। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের একমাত্র পথ হচ্ছে সরাইলে পূর্ণ দায়িত্বের একজন সাব-রেজিষ্ট্রার পোষ্টিং। ডেপুটেশনে থাকা সরাইল উপজেলা সাব-রেজিষ্ট্রার আবদুল কাদির বলেন, রাত হয়ে গেছে। তবুও কাজ করছি। যতক্ষণ দলিল আছে ততক্ষণ কাজ করব। রাত যতই হউক। এক সপ্তাহের দলিল জমে থাকে। তাই ক্রেতা বিক্রেতার এই ভীর। এই কষ্ট সাময়িক। তবে এই পদে জনবল সংকটের কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দফতরের জনৈক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।