দুর্ঘটনা একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জল ও স্থল পথে। তবে দেশের ইতিহাসে যাত্রীবাহী নৌযানে সবচেয়ে বড় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার। ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ নামের একটি তিনতলা লঞ্চে কয়েক শ যাত্রী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিলেন। রাত ৩টার কিছু পরে হঠাৎই আগুন লেগে যায় লঞ্চটিতে। লঞ্চটি তখন ছিল ঝালকাঠি লঞ্চঘাট থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সুগন্ধা নদীর বুকে। বিকট শব্দ ও চিৎকারে ঘুম থেকে জেগে যাত্রীরা ছোটাছুটি শুরু করেন। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেন। এভাবে ঘণ্টাখানেক চলার পর লঞ্চটি এক পারে গিয়ে থেমে যায়। ততক্ষণে আগুনে পুড়ে চলে যায় ৩৫ জনের প্রাণ। পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় আরো তিনজনের। দগ্ধ হয়ে ও লাফিয়ে পড়ে আহত হন শতাধিক। ফায়ার সার্ভিস, নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ডের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনও নৌকা নিয়ে উদ্ধারকাজে অংশ নেন। স্বজনদের তথ্য অনুযায়ী শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত অর্ধশত যাত্রী নিখোঁজ ছিলেন।
ধারণা করা হচ্ছে, লঞ্চের ইঞ্জিনরুম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসও তাই মনে করছে। কারো কারো মতে, ইঞ্জিনরুমের পাশে থাকা ক্যান্টিনে বিকট শব্দে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয় এবং আগুন লেগে যায়। দ্রুত সে আগুন ইঞ্জিনরুমে ও তার পাশে থাকা ছয় হাজার লিটার ডিজেলে ছড়িয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পর দোতলার ক্যান্টিনেও সিলিন্ডার বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগও করছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ বলছেন, ভেতরে অগ্নিনির্বাপকের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কেউ কেউ দাবি করছেন, ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার ছিল। ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকুক বা না থাকুক, আগুন নেভানোর যে চেষ্টা করা হয়েছে, তেমন কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। এক্সটিঙ্গুইশার থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করার মতো প্রশিক্ষণ হয়তো কারো ছিল না। তদন্তের পর রিপোর্ট যদি প্রকাশ্যে আসে, তাহলে জানা যাবে সেখানে প্রকৃতপক্ষে কী কী ঘটেছিল। কিন্তু রিপোর্টে যা-ই আসুক, যে ৩৮ জনের প্রাণ গেছে তাঁদের আর ফেরানো যাবে না।
অভ্যন্তরীণ নদীপথে চলাচলকারী নৌযানগুলোর নকশা, নির্মাণ, ইঞ্জিনের মান ইত্যাদি নিয়ে বহু প্রশ্ন রয়েছে। অতীতে এই ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা গণমাধ্যমে নৌযানের এমন অনেক ত্রুটির কথা তুলেও ধরেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব অনিয়ম ও ত্রুটি দেখার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেন না। নৌযান ফিটনেসের অংশ হিসেবেই সেখানে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষিত জনবল থাকার কথা। ফিটনেস সনদ দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্টরা সে বিষয়গুলো নিশ্চিত করেছিলেন কি? তা না করে থাকলে এখন এই হতাহতের দায় কি তাদের ওপরও বর্তাবে না?