লঞ্চ মালিকদের অপকৌশলের কারণে নৌপথে চলাচলকারী যাত্রী সাধারণ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন, ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়সহ নানা ঝুঁকিতে যাত্রীরা পড়ছেন। লঞ্চ মালিকরা রোটেশন প্রথা বা পালা করে লঞ্চ চলাচল করান একচেটিয়া ব্যবসা নিশ্চিত করতে; গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করলে ইচ্ছে মত ভাড়া আদায় করে অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য। ঢাকা থেকে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার পথে নয়টি লঞ্চের চলাচলের অনুমতি থাকলেও মাত্র দু’টি লঞ্চ যাওয়া আসা করে। অথচ ঢাকা থেকে ভান্ডারিয়ার উদ্দেশ্যে চারটি লঞ্চ ছেড়ে যাবার কথা। একইভাবে ভান্ডারিয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যেও চারটি লঞ্চ ছাড়ার কথা। সবচে ব্যস্ত নৌপথ হচ্ছে, ঢাকা-বরিশাল। এপথে ১৭টি লঞ্চের রুট পারমিট আছে। অর্থাৎ প্রতিদিন অন্তত আটটি করে লঞ্চ ঢাকা ও বরিশাল থেকে ছাড়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে ছ’সাতটির বেশি ছাড়ে না। অন্যদিকে ঢাকা থেকে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কালাই রুটে চারটি লঞ্চের পারমিট আছে। প্রতিদিন উভয় প্রান্ত থেকে দু’টি করে লঞ্চ ছাড়ার কথা থাকলেও ছাড়ে একটি করে। ঢাকা থেকে বরগুনা রুটে রুট পারমিট আছে ছয়টি লঞ্চের। কিন্তু চলাচল করে চারটি। ঢাকা থেকে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ রুটে চারটি লঞ্চের রুট পারমিট থাকলেও উভয় প্রান্ত থেকে চলাচল করে একটি করে লঞ্চ।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, সদরঘাট থেকে ৪৪টি নৌপথে চলাচলের জন্যে ২২২টি যাত্রীবাহী লঞ্চের রুট পারমিট আছে। এসব লঞ্চ নিদিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার পথে বিভিন্ন জায়গায় থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করায়। বাস্তবে দেখা গেছে দু’একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট ছাড়া সব রুটেই নির্ধারিত সংখ্যক লঞ্চ চলাচল করে না। যাত্রী সেবা বৃদ্ধি করে কেউ লঞ্চ নামাতে চাইলে লঞ্চ মালিক সমিতি বাঁধ সাঠে। তারা নতুন লঞ্চ না নামাবার জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে (নৌ-রুট পারমিট, সময়সূচী ও ভাড়া নির্ধারণ) বিধিমালায় বলা হয়েছে, রুট পারমিটের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে মালিক সমিতির পরামর্শ নিতে পারবে। আর এই বিধানের সুযোগ গ্রহণ করছে লঞ্চ মালিক সমিতি। ফলে লঞ্চ মালিক সমিতির পূর্ব অনুমতি না নিয়ে কেউ লঞ্চে বিনিয়োগ করতে পারছে না।
সদরঘাটে মোট ৩২টি টিকেট কাউন্টার থাকলেও অধিকাংশ লঞ্চ মালিক তা ব্যবহার করেন না। কাউন্টার লঞ্চ মালিকরা বরাদ্দ নিলেও তারা যাত্রীদের কাছে টিকেট বিক্রি করেন লঞ্চে ওঠার পর। ফলে লঞ্চের যাত্রী ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি টিকেট বিক্রি করা যায়। টিকেট বিক্রির হিসাব না থাকায় গাদাগাদি করে যাত্রীরা লঞ্চে যাতায়াত করেন। লঞ্চ যাত্রীরা সাধারণত কেবিন, চেয়ার ও সাধারণ ডেকে চলাচল করে থাকেন। অগ্রিম টিকেট দেবার কোনও ব্যবস্থা নেই। ফলে লঞ্চের কেবিন পাওয়া যেন সোনার হরিণ। প্রভাব বা অতিরিক্ত টাকা দালালদের দিয়ে কেবিন বুকিং নিতে হয়। লঞ্চ মালিকদের রোটেশন প্রথার মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে যাত্রী হয়রানীর বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে এ প্রথা বাতিলের বিরুদ্ধে ভোলায় মানব-বন্ধন হলেও তা বন্ধ করা সম্ভব হয় নি। তবে সদর ঘাটে নৌ টার্মিনাল থেকে লঞ্চ ছাড়ার আগে লঞ্চের যাত্রী সংখ্যা ও লঞ্চের ফিটনেস সংক্রান্ত ছাড়পত্র দেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিদর্শকরা উৎকোচের বিনিময়ে যাত্রী সংখ্যা কম ও ক্রুটি থাকলেও লঞ্চে কোনো ক্রুটি নেই মর্মে সার্টিফিকেট দেন। ঝালকাঠিতে পুড়ে যাওয়া অভিযান ১০-এর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। কাজেই নৌপথে যাত্রী হয়রানী ও দুর্ঘটনায় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ তাদের দায় এড়াতে পারে না। অতিরিক্ত যাত্রী বুঝাইয়ের কারণে প্রায়ই নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া যায়। তাতে প্রাণহানিও ঘটে। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত রুট পারমিটের লঞ্চগুলো যথাযথভাবে চলাচল করছে কিনা, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করছে কিনা তা তদারক করা। নৌপথের বিশৃঙ্খলা দূর করতে না পারলে যাত্রীরা নিরাপদ হবে না।