ঢাকা কিংবা বরিশাল নৌ-পথের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তের দূরত্ব মাত্র আটঘন্টা। এজন্য শ্রেণি ভেদে মোটা অংকের টাকা ভাড়া নেওয়া হয় যাত্রীদের কাছ থেকে। কিন্তু আট ঘন্টার এই রাত্রীকালীন সার্ভিসে এক থেকে দুই ঘন্টা সেবা দেওয়ার পর আর খুঁজে পাওয়া যায় না লঞ্চের স্টাফদের।
রাত গভীর হলে দুই-তিনজন লঞ্চ স্টাফ ছাড়া বাকিরা সবাই ঘুমিয়ে পরেন। এ সময় হাজারো যাত্রীর নৌযাত্রা হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ অনিরাপদ। ফলে ঝালকাঠীর সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহি এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের সময় দায়িত্বপ্রাপ্তরা ঘুমিয়ে থাকায় শুরুতেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। এমন অবস্থায় আট ঘন্টার পুরো সার্ভিসে লঞ্চ স্টাফদের সেবা চান যাত্রীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বরিশাল কিংবা ঢাকার উভয়প্রান্ত থেকে প্রতিদিন রাত নয়টার পর থেকেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় যাত্রীবাহি জাহাজগুলো। আর এসব লঞ্চ গন্তব্যে পৌঁছে ভোর পাঁচটার দিকে। এ সময় ডেকের কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রীরা লঞ্চের রেস্তোরাঁয় কিংবা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রাতের খাবার শেষ করেন। স্যুট, ভিআইপি কিংবা কেবিন যাত্রীদের খাবার পর্ব শেষ হয় রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। তাদের সেবা দেওয়ার জন্য লঞ্চে নিয়োজিত রয়েছেন কেবিন বয়। এসব কেবিন যাত্রীদের খাওয়ানো শেষতো তাদের ডিউটিও শেষ হয়ে যায়। লঞ্চটি গন্তব্যে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আর তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এ কারণে ছোট-বড় দুর্ঘটনা কিংবা সম্ভাব্য বিপদের শুরুতেই যাত্রী এবং মালিকের সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব হয়না।
আবুল কালাম আজাদ নামের প্রথম শ্রেণির একজন নৌযাত্রী জকণ্ঠকে বলেন, ঘাট থেকে অনেক আদর করে ডেকে যাত্রীদের লঞ্চে তোলা হয়। লঞ্চটি ঘাট ত্যাগ করার পর স্টাফরা কে কোথায় যায় তার কোন হদিস থাকেনা। যাত্রীদের যেকোন সমস্যা হলে লঞ্চের কর্মচারীদের হন্য হয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। যেকারণে প্রায়ই লঞ্চের কেবিনে হত্যাকান্ডের মতো লোমহর্ষক ঘটনা লেগেই রয়েছে।
কেএম সোহেব জুয়েল নামের এক কেবিন যাত্রী বলেন, ভাড়ার টাকাতো তারা কম নেয় না কিন্তু সেবার বেলায় নেই। মধ্যরাতে খাবার পানির প্রয়োজন হলেও কাউকে পাওয়া যায়না। গন্তব্যের উদ্দেশ্যে লঞ্চ ছাড়ার দুই ঘন্টা পরই সবাই ঘুমায়। সাকিল মাহমুদ আউয়াল খান নামের এক যাত্রী বলেন, লঞ্চের কেবিনের চাবি হাতে পাওয়ার পর ভোরে বিদায় হওয়ার সময় চাবি হস্তান্তরের আগে লঞ্চের স্টাফদের সেবা নামমাত্র। রাত ১১টার মধ্যেই সবাই ঘুমিয়ে পরে।
তিনি আরও বলেন, কৌতুহলবশত যাত্রাপথে রাত আড়াইটার দিকে পুরো লঞ্চ পরিচালনা ঘুরে দেখা গেছে নীচে ইঞ্জিন রুমে একজন ড্রাইভার ও তার সহকারী গ্রীজার এবং মাস্টার ব্রীজে একজন সুকানী (দিক নিয়ন্ত্রণকারী) চালিয়ে নিচ্ছেন হাজারো যাত্রী বোঝাই বিলাস বহুল লঞ্চ। তিনি বলেন, মাত্র আট ঘন্টার রাত্রীকালীন সার্ভিস। অথচ হাজারো যাত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করে লঞ্চের সকল স্টাফ ঘুমিয়ে থাকেন। বিষয়গুলো লঞ্চ মালিক কিংবা বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ কেউ তদারকি করেন না। তার দাবি ঝালকাঠীর সুগন্ধা নদীতে যখন অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়, তখন ওই লঞ্চের ২/৩ জন কর্মী ছাড়া সবাই ছিলো গভীর ঘুমে। এ কারণে শুরুতেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্তরা যথাযথভাবে দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলে শুরুতেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো।
সূত্রমতে, ঢাকা-বরিশাল রুটের বিলাসবহুল যাত্রীবাহি প্রতিটি লঞ্চ পরিচালনার জন্য ৪০ থেকে ৪৫ জন স্টাফ নিয়োজিত থাকেন। যাত্রীদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব সুুপারভাইজারের। ভাড়া আদায় করেন তিনজন কেরানী। লঞ্চটি চালনার দায়িত্ব প্রথম শ্রেণির দুইজন মাস্টারের। তাদের নির্দেশনায় এদিক-সেদিক করে মাঝ নদীতে লঞ্চ চালিয়ে নেন দুইজন সুকানী। ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দুইজন ড্রাইভার এবং ড্রাইভারের সহকারী দুইজন গ্রীজার। এ ছাড়া লঞ্চ নোঙ্গর করাসহ সিঁড়ি টানাটানির জন্য ৬/৭ জন লস্কর, ১৫/২০ জন কেবিন বয়, একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান এবং মালিকের স্বার্থ দেখার জন্য তিন থেকে চারজন নিরাপত্তাকর্মী। মধ্যরাতে এদের মধ্যে দুই থেকে তিনজন ছাড়া সবাই থাকেন গভীর ঘুমে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির পরিচালক ও সুরভী নেভিগেশনের চেয়ারম্যান মোঃ রিয়াজুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, রাত্রীকালীন সার্ভিসে স্টাফদের ঘুমাতে হয়। তবে তারা রাত একটার আগে ঘুমায় বলে মনে হয়না। এ ছাড়া দিন-রাত সবসময় কর্মীরা লঞ্চেই থাকেন। তারপরেও বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, লঞ্চে সেবা অপ্রতুল থাকতে পারে। যাত্রীরা যাতে পর্যাপ্ত সেবা পায়, সে বিষয়টি মালিকদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত করা হবে। উল্লেখ্য, ঢাকা-বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নৌ-রুটে প্রতিদিন দুই শতাধিক বিলাসবহুল যাত্রীবাহি লঞ্চ চলাচল করছে।