দেশের ৬০ ব্যাংকের মধ্যে ২৫টি ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তিই সীমাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ৫টি ব্যাংক। ওসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার বেশি হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে গেছে। কয়েকটি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতেও পড়েছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন খাতে মোটা অঙ্কের অর্থ আটকে রয়েছে। তার মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবেও কয়েকটি ব্যাংকের এলসি সরাসরি গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। তৃতীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি লাগছে। ফলে ব্যবসা খরচ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আন্তর্জাতিকভাবে কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশের বেশি থাকলে ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ওই হার ৫ শতাংশের বেশি থাকলে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে সরকারি খাতের ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের রয়েছে ২০ দশমিক ০৭ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতের ৪২টি ব্যাংকে রয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বিশেষায়িত ৩টি সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গড়ে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। তবে ২টি ব্যাংকের মাত্রতিরিক্ত খেলাপি ঋণ রয়েছে। সব মিলে সরকারি খাতের ৯টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ। সরকারি খাতের ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সবকটিতেই খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের বেশি। ৪২টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ১৪টির ৫ শতাংশের ওপরে। ৯টি বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে ২টি ব্যাংকের এবং ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংকের সবকটিতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি খাতের নতুন প্রজন্মের ৪টি ব্যাংকেরও খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের ওপরে।
সূত্র জানায়, দেশে কর্মরত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৫টি ব্যাংকের ৫০ শতাংশের ওপরে খেলাপি ঋণ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। তার মধ্যে বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির অর্থ আদায় করতে পারছে না। যে কারণে ব্যাংকির খেলাপি ঋণ কমছে না। কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকেরও (সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংক) একই অবস্থা। আর ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কার্যক্রমে স্থবিরতা চলছে।
সূত্র আরো জানায়, ৪টি গ্রুপের কারণে ৩টি সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। ওসব গ্রুপের কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। এখন ওসব ঋণ আদায়ে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু আইনের ভেতর দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। যে কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো ভুগছে। মূলত রাজনৈতিক চাপেই খেলাপি ঋণ কিনে কয়েকটি ব্যাংক নতুন ঋণ দিতে বাধ্য হয়েছে। ওসব ঋণও এখন আদায় হচ্ছে না। আর সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুব বেশি তদারকি করতে পারে না। ফলে নানা চাপে তাদের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ রাখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের মালিকানাধীন দুটি ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশেরও বেশি। তার মধ্যে হাবিব ব্যাংকের ১৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৯৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। আর সরকারি খাতের বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ১৯ দশমিক ২৯ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে।
এদিকে বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের অভিমত, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের ছোবল কমাতে হবে। তা না হলে ব্যাংকগুলো সাউন্ড হবে না। আন্তর্জাতিকভাবেও নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। ব্যবসায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ঋণের মান ভালো না হওয়ার কারণে খেলাপি বাড়ছে। মানসম্পন্ন ঋণ বিতরণ করতে হবে। তার জন্য দরকার সুশাসন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। যেসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে, সেগুলোর ঘাটতি পূরণে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া ও আদালতে মামলার কারণে কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।