স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর সমগ্র দেশের সাথে সরাইলেও নির্মিত হয়েছে বহুতল বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন। কাজ শেষ হয়েছে ৩ বছর আগে। কিন্তু রাজনৈতিক মারপ্যাচে আটকে আছে ভবনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। পেছনে রয়েছে নানা রহস্য। আহবায়ক, সাবেক ইউএনও ও ঠিকাদারের বক্তব্যেও রয়েছে গড়মিল। উপজেলা প্রকৌশলী পরে কথা বলবেন বললেও আর কিছুই বলেননি। ওদিকে দীর্ঘ সময় অব্যবহৃত থাকায় নষ্ট হচ্ছে ভবনের সৌন্দর্য। অযতেœ অবহেলায় পড়ে থাকা লাখ লাখ টাকা মূল্যের আসবাপপত্রে বালুর স্তুপ। ৬ মাস আগে পাওয়া কম্পিউটার সেট (প্রিন্টারসহ) পড়ে আছে এলজিইডি অফিসে। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের পাশেই ফেলছে ময়লা আবর্জনা। ভবনের সামনে ভেতরে দক্ষিণ পাশে নিয়মিত চলছে মলমূত্র ত্যাগ। দূর্গন্ধে নাক চাপতে হয়। প্রধান ফটকের সামনে গাড়ির গ্যারেজ। গত ৩ বছরে মারা গেছেন স্থানীয় ৮-৯ জন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা ভবনে সভা সেমিনার করার স্বপ্ন অপূরণীয়ই রয়ে গেল তাদের। এখনো জীবিত অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভবনটির পাশ দিয়ে হাঁটেন। আর আফসোস করে বলেন, কখনো কি উদ্বোধন হবে এটি? আমরা কি এ ভবনটিতে বসে মরতে পারব?
সংশ্লিষ্ট দফতর, মুক্তিযোদ্ধা ও ঠিকাদার সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয় ১১ সদস্য বিশিষ্ট সরাইল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল। কমান্ডার মো. ইসমত আলী আর ডেপুটি কমান্ডার মো. আনোয়ার হোসেন। একাধারে ৩ বছর দায়িত্ব পালন করে ওই কমিটি। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের কোন একসময় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পুনরায় নির্বাচন দেননি। একসময় সরকারি সিদ্ধান্তে ভারপ্রাপ্ত কমান্ডারের দায়িত্ব পান ইউএনও। এর কিছুদিন পরই সমগ্র দেশের সাথে সরাইল ও বরাদ্ধ পায় উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন। উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের সহায়তায় সরাইলের প্রাণ কেন্দ্রে ৮ শতক জায়গার ব্যবস্থা হয়। ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকায় চারতলা ফাউন্ডেশনের ৩ তলা ভবন নির্মাণ কাজের দরপত্র আহবান করা হয়। কাজটি পান ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘খন্দকার এ- ব্রাদার্স’। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বের নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন তৎকালীন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা ও ইউএনও উম্মে ইসরাত। ভবনের পুরো কাজ শেষ হয় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে। নীচতলায় ও দ্বিতীয়তলায় মোট ১২টি দোকান। আর তৃতীয় তলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি হল রূম। কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডারের অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃথক দুটি কক্ষ। প্রধান ফটক সংলগ্ন স্থানে স্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর সরকারি খরচায় এমন সুন্দর একটি ভবন পেয়ে খুবই খুশি মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু উদ্বোধন নিয়ে শুরূ হয়ে যায় তামাশা ও কূটচাল। কে করবেন উদ্বোধন? মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী নাকি স্থানীয় এমপি? গ্রƒপিং এর কারণে ভিন্ন মত ও বিভক্তি। চরম বেকায়দায় পড়ে যান ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার ও নির্বাহী অফিসার। কোন ভাবেই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছেন না ইউএনও। ফলে বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে উদ্বোধন হচ্ছে না। অযতেœ পড়ে আছে ভবনটি। সুযোগে ভবনটির ফটকের সামনে গড়ে তুলছে গ্যারেজ। আশপাশে ময়লার স্তুপ। ভবনের ভেতরে ফেলা হচ্ছে ময়লা আবর্জনা। নিশ্চিন্তে দিনে রাতে চলছে মলমূত্র ত্যাগের কাজ। সুযোগে চলছে মাদক সেবনের কাজও। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ নাজমুল হক ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত সংশোধিত পরিপত্রে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন পরিচালনা রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য ৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। আহ্বায়ক ইউএনও, সদস্য উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি), ২০১৪ সালে নির্বাচিত উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার, সদস্য সচিব উপজেলা সমাজসেবা অফিসার। এই কমিটিই ভবন ব্যবহার, তদারকি, মনিটরিং, ১ম ও ২য় তলা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জামানত ভাড়া নির্ধারণ ও হস্তান্তর, জনবল নিয়োগ, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত ভবন ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ও আর্থিক আয়-ব্যায়ের হিসাব পরিচালনা করবেন। আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. ইসমত আলী ও মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, অনেক কষ্ট ও ত্যাগে ভবন পেলাম। দুই বছর ধরে ঘুরছি। উদ্বোধন হচ্ছে না। ভবনের ভেতরে যেতে পারছি না। অনেক মূল্যবান আসবাপপত্র নষ্ট হচ্ছে। আহ্বায়ক ইউএনও মহোদয় শুধু বলছেন, অপেক্ষা করূন। সমস্যা আছে। কাকে দিয়ে উদ্বোধন করাবেন ঠিক করূন। আমাদের আর সহ্য হচ্ছে না। অনেক সাথী (মুক্তিযোদ্ধা) ভবনের কাজ শুরূ দেখেছেন। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আমাদেরকেও হয়ত ভবন ব্যবহার না করেই মরতে হবে। একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আর কিছু না। শুধু রাজনৈতিক মারপ্যাচে এ ভবনের উদ্বোধন আটকে আছে। আহ: মুক্তিযোদ্ধাদের ভবন নিয়েও রাজনীতি? আর যাব কোথা? ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মো. শফিকুল ইসলাম খন্দকার বলেন, কাজ শেষ করে ৩ বছর আগেই লিখিত ভাবে হ্যান্ড অভার করেছি প্রকৌশলীর কাছে। প্রকৌশলী লিখিত ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন তৎকালীন নির্বাহী অফিসারকে। সকল বিল ও সিকিউরিটির টাকাও উত্তোলন করে ফেলেছি। এ-সংক্রান্ত কাগজপত্রও হাতে আছে। এখনো বুঝিয়ে দেয়া হয়নি এমন বক্তব্য সঠিক নয়। সদস্য সচিব ও সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রকল্প কর্মকর্তা মনে হয় ভবনের কাজটি এখনো শতভাগ বুঝিয়ে দিতে পারেননি। ইউএনও মহোদয়ের সাথে কথা বললে আরো পরিস্কার জানতে পারবেন। কমিটির আহ্বায়ক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আরিফুল হক মৃদুল বলেন, ওঁরা (মুক্তিযোদ্ধারা) হয়ত পুরাতন অফিসেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। আর উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) এখনো আমাকে ভবনের কাজটি বুঝিয়ে দেননি। এ ছাড়া উদ্বোধনের বিষয়ে সরকারি কোন সিদ্ধান্তও পায়নি। তৎকালীন (সরাইলের সাবেক) ইউএনও এ এস এম মোসা বলেন, ভবনটি নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সামান্য ২/১ ছোট কাজ বাকী ছিল। উদ্বোধন হয়নি। তাই মুক্তিযোদ্ধারা ভবনে ওঠতে পারেননি। এতদিনে তো সব হয়ে যাওয়ার কথা। অব্যবহৃত থাকলে এতবড় সম্পদটি নষ্ট হয়ে যাবে। আপনারা সকল সহযোগীতা করে ভবনটি উদ্বোধনের ব্যবস্থা করেন।