সরকার পুষ্টিগুণ ঠিক রাখতে চাল অতিরিক্ত ছাঁটাই বন্ধ করতে যাচ্ছে। ওই লক্ষ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালা করছে। তাতেই নির্ধারণ করে দেয়া হবে চাল ঠিক কতটুকু ছাঁটাই করা যাবে। নীতিমালায় নির্ধারিত পরিমাণের বেশি ছাঁটাই করলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও। নীতিমালাটি বাস্তবায়িত হলে বাজারে মিনিকেট, নাজিরশাইলের মতো চাল থাকবে না। বর্তমানে ব্যাপক চাহিদার কারণে চাল অতিরিক্ত ছাঁটাই ও পলিশ করে চিকন বানিয়ে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। তাতে চালের পুষ্টিগুণ কমে যাচ্ছে। সেজন্যই চালের কত অংশ ছাঁটাই করা যাবে তা বেঁধে দিতে যাচ্ছে সরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চাল অতিরিক্ত ছাঁটাই করার কারণে দেশের মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। সেজন্য সরকার বিদেশ থেকে পুষ্টিচাল এনে খাওয়াচ্ছে। দেশের চালে পুষ্টিটা ধরে রাখা গেলে মানুষের অনেক উপকার হবে। বাজারে চাল ছাঁটাই ও পলিশ করে মিনিকেট এবং নাজিরশাইল করা হয়। অথচ মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে কোন ধানের জাত নেই। মিনিকেট ও নাজিরশাইল বানাতে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত চাল ছাঁটাই করা হচ্ছে। আর ওসব চাল খেয়ে পুষ্টিবঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
সূত্র জানায়, দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তারা চিকন চাল খেতে চায়। আর অসাধু ব্যবসায়ীরা ওই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে। চাল ছেঁটে চিকন করে বিক্রি করছে। মোটা চাল চিকন করার ক্ষেত্রে বাইপ্রোডাক্ট (উপজাত) যেটা থাকে সেটা আরো বেশি দামে বিক্রি করে। গুঁড়াটা বিস্কুট ফ্যাক্টরি, স্টার্চসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ওই ধরনের পুষ্টিহীন চিকন চাল খাবে, নাকি যে ধান ওই নামেই চাল খাবে। এখন দেশে ধানের যে জাতগুলো আছে তার বেশিরভাগই চিকন ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। কিন্তু মিলাররা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত চাল ছাঁটাই করে। সাধারণত হাইব্রিড চালগুলো মোটা হয়। মিলাররাগুলো তা পলিশ করে চিকন করে। আর ক্রেতা বাজারে গিয়ে হাইব্রিড পাবে না। মিনিকেট নামে চালের কোন জাত নেই। কিন্তু এখন ওই নামেই একটা চাল ব্র্যান্ডিং করে ফেলা হয়েছে। মূলত ব্রি-২৮, ব্রি-২৯সহ অন্যান্য চাল কেটে মিনিকেট করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে চাল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সুবিধা এবং পুষ্টিও থাকবে এমন একটা ব্যবস্থায় যাওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর ওসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই ছাঁটাই নীতিমালা করা হবে।
সূত্র আরো জানায়, ৮ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত চাল ছাঁটাই করলে চালের পুষ্টি উপাদান থাকবে। তার বেশি করলেই পুষ্টি কমে যাবে। বর্তমানে সরকার বাইরে থেকে এনে পুষ্টি চাল খাওয়াচ্ছে। আর দেশের ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত ছাঁটাই করে পুষ্টিগুণ কমিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে শুধু ব্রি উদ্ভাবিত জাতেরই চাষ হয় না। ট্র্যাডিশনালি চাষ হয় এমন অনেক জাতও রয়েছে। স্থানীয়ভাবে কৃষকরা মিনিকেট জাতের চাষ করে তা ব্রি উদ্ভাবিত নয়। সেটা ভারত থেকে এসেছে। আর মিনিকেট ধানের জাত থেকে থাকলেও তার চাষ হয় খুবই কম। কিন্তু বাজারে ব্যাপকভাবে মিনিকেট পাওয়া যায়। ওই পরিমাণ তো বাংলাদেশে চাষ হয় না। যদি ধরেও নেয়া হয় দেশে ৫ শতাংশ মিনিকেট ধানের চাষ হয়। কিন্তু বাজারে চালের ৫০-৬০ শতাংশই মিনিকেট। নিশ্চয়ই অন্য জাতের চালকে মিনিকেট নামে চালানো হচ্ছে। আর চালের ব্র্যান্ড নাম যাই হোক সরকার চায় বস্তায় ধানের জাতের নামটা থাকুক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কৃষক অনেক সময় ধানের কোন নির্দিষ্ট জাত সংরক্ষণ করে না। মোটা, চিকন ও মাঝারি- ওই তিন ধরনের ধান আলাদা আলাদা করে রাখে।
এদিক কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, দেশের মানুষ মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে চাল খেলেও ওই নামে কোন ধানের জাত নেই। মূলত এদেশে যে জাতগুলো আছে সেগুলো কেটে-ছেঁটে বা পলিশ করে চাল করা হচ্ছে। কিন্তু চালের পুষ্টিগুণ পেতে হলে সাড়ে ৭ থেকে ১০ শতাংশের বেশি চাল ছাঁটাই করা যাবে না। তা মেনটেন করা গেলে চালের স্বাদ ও পুষ্টি ঠিক থাকবে। আর বিজ্ঞানীরা যে উদ্দেশ্যে চালগুলোতে জিংক, আয়রন, ভিটামিন ঢুকাচ্ছে, পুষ্টিসমৃদ্ধ নতুন নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করছে, অতিরিক্ত ছাঁটাইয়ের কারণে দেশের সাধারণ মানুষ যদি ওই পুষ্টি না পায় তাহলে ওই আবিষ্কার করে লাভ কী? সেজন্যই একটা নীতিমালা করতে হবে। ওই নীতিমালায় বলে দেয়া হবে কত শতাংশ পর্যন্ত চাল ছাঁটাই করা যাবে।
এ বিষয়ে খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জানান, সরকার চাল ছাঁটাই নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে। অন্য দেশে ছাঁটাই নীতিমালা আছে কি না কিংবা তারা কতটুকু চাল ছাঁটাই করে, তা দেখা হচ্ছে। ব্রিসহ (বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট) সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। তারা নীতিমালা তৈরির কাজ করছে। যেটা যৌক্তিক, তারা সেটাই করবেন। কমিটিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দফতরের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। যারা ধান নিয়ে কাজ করেন কমিটিতে তেমন বিশেষজ্ঞরাও রয়েছেন।