সড়কে যেন মৃত্যুর মিছিল থামছে না। সময়ের ব্যবধানে তা যেন হু হু করে বাড়ছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দাবিতে সে সময় সরকার সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ প্রণয়ন করলেও তা বাস্তবায়নে সুষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে। ফলে সড়ক অনিরাপদ থেকে যায় চালকদের অদক্ষতা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, ফুটপাত হকারদের দখলে থাকা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সক্ষমতার ঘাটতি, গণ-পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি ও সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনার কারণে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে গত ২০১৯ সালে মোট ৪ হাজার ৬৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হাজার ২১১ জন। ২০২০ সালে ৪ হাজার ৭৩৫ টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৫ হাজার ৪৩১ জন। আর বিগত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৫ হাজার ৩৭১ টি। এতে মারা যান ৬ হাজার ২৮৪ জন। ক্রমবর্ধমান এ প্রাণহানি ঘটে চললেও সংশ্লিষ্টরা সচেতন হচ্ছেন না। সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা এটাকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যা বলছেন। অথচ সরকার এর দায় নিচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে। পরিবহন খাতে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এমনটা হতো না। বরং সরকার পরিবহন মালিকদের পরিবহন খাতের নীতি নির্ধারনী কমিটির সদস্য করায় সচেতন সমাজ বিব্রত।
২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ আর মৃত্যু বেড়েছে ১৭ শতাংশ। অথচ এ সময় করোনা সংক্রমণের কারণে মোট ৮৫ দিন গণ-পরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। গত বছরের ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধের কারণে সরকার গণ-পরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। পরে ২০ মে থেকে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণ-পরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। আবারো ২৮ জুন থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। এরপর ২৩ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত বিধি নিষেধ চলে। দীর্ঘ সময় গণ-পরিবহন বন্ধ থাকলেও গত বছর সড়কে মানুষের মৃত্যুর তালিকা ছোট করতে পারে নি।
২০২১ সালে সড়কে মানুষ মরেছে প্রতিদিন ১৭ জনের বেশি। আর ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৮৫ দিন গণ-পরিবহন বন্ধের হিসাব ধরলে গড়ে দৈনিক ২২ জনের বেশি মানুষ মরেছে। শুধু মৃত্যুর তালিকা নয় সড়ক দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যাও বেশ আতঙ্কজনক। ২০২১ সালে সড়কে আহত হয়েছে ৭ হাজার ৪৬৮ জন। এর মধ্যে ৮০৩ জন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। ছোট গাড়ি বড় ঝুঁকি হয়ে উঠেছে মোটর সাইকেল। ২০২১ সালে মোট দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় গত বছর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত বছর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ২১৪ জন প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে ১৪ থেকে ৪৫ বছরের চালক বেশি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বলছে, পাঁচ বছর আগে দেশে ৮ লাখের কাছাকাছি মোটর সাইকেল থাকলেও এখন নিবন্ধিত মোটর সাইকেলের সংখ্যা ৩৫ লাখের বেশি।
অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু কারো কাম্য হতে পারে না। তাই সড়কে প্রাণহানি মেনে নেয়া যায় না। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রদর্শনের মাধ্যমে সড়কে নিয়মের বেড়াজাল তৈরি করে প্রাণহানি রুখতে হবে। শুধু কারিগরি ভাবে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সড়কের বিশৃঙ্খল পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সড়ক মৃত্যুর দুয়ার হয়েই থাকবে। এটা কারো প্রত্যাশিত নয়।