বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। নদীবিধৌত সুজলা সুফলা এই দেশের মাটিতে যুগ যুগ ধরে ধান, গম থেকে শুরু করে নানা খাদ্যদ্রব্য উৎপাদিত হয়ে আসছে।কৃষির ওপর নির্ভরশীল করে এদেশের সিংহভাগ মানুষ।কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, কৃষিনির্ভর এই দেশের কৃষিজমির পরিমাণ প্রতিবছর আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে।
কৃষির উন্নয়নে কৃষিনীতি আছে। জাতীয় কৃষিনীতি-১৯৯৯। কিন্তু তা শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ।এই কৃষিনীতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্প-কারখানা স্থাপন, আবাসনসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠছে কৃষি জমিতে। এ কারণে প্রতি বছর প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, চার দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশে আবাদি জমি কমেছে প্রায় ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট। ১৯৮০ সালে মোট জমির ৬৫ শতাংশের বেশি ছিল আবাদি। ২০১৯ সালে তা ৫৯ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, ১৯৮০ সালে মোট জমির তুলনায় কৃষিজমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা ১৯৯০ সালে ৬৫ দশমিক ৫০ ও ২০০০ সালে ৫৯ দশমিক ৩০ শতাংশে নেমে আসে। কৃষিজমির পরিমাণ কমার এ হার পরবর্তী বছরগুলোতেও অব্যাহত ছিল। ২০১০ সালে মোট জমির মাত্র ৫৮ দশমিক ২০ শতাংশ ছিল কৃষিজমি, যা ২০১৯ সালে ৫৯ দশমিক ২৮ শতাংশে নেমে আসে।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের দেশের কৃষি জমি মৌলিকভাবে উৎকৃষ্টমানের, তবে বর্তমানে এর মান নানাস্থানে নানাভাবে কমছে। জনপ্রতি আবাদি জমির পরিমাণ পৃথিবীর অন্যান্য জনবহুল ও কৃষি প্রধান দেশের চেয়ে কম। কৃষি জমি কমে গেলে অবশিষ্ট জমির উপর চাপ বাড়তে থাকে। রাস্তাঘাট, আবাসন ও শিল্পকারখানার ফলে কৃষি জমি দিন দিন অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এতে বন্যার পানি নিষ্কাশনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে। ফসলি জমি জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। কৃষক হচ্ছে আর্থিকভাক্ষে ক্ষতিগ্রস্থ। এতে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, জমির উর্বরা শক্তি কমবার এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সব মিলিয়ে কৃষি জমি কমে চলেছে এবং অবশিষ্ট জমির উপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই।
দেশের সর্বত্র এখন ইট ভাটার সংখ্যা বাড়ছে এবং সে কারণেও নষ্ট হচ্ছে আবাদি জমি। ইট ভাটার জন্য সাধারণত ব্যবহার করা হয় আবাদি জমির উপরের উর্বর মাটি। যে মাটি কৃষি আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। একবার আবাদি জমির উপরের মাটি কেটে নিয়ে গেলে অন্তত ১৫ বছর সময় লাগে তা আগের অবস্থায় ফিরে আসতে। এর ফলে উৎপাদন হয় ব্যাহত। কৃষিজমির উর্বরতা ফিরিয়ে আনতে বিশেষজ্ঞরা অপরিকল্পিতভাবে জত্রতত্র ইটভাটা বন্ধের পরামর্শ দিচ্ছেন।
আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাসের আরও কিছু কারণ হলো ধানের মনোকালচার, রাসায়নিক সার ব্যবহার এবং জমির অর্গানিক উপাদান হ্রাসের কারণে ভূমি উর্বরতা কমছে। এ ছাড়া রয়েছে ভূমির অসম বন্টন। বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান অধিদফতর) -এর উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪৫% পরিবার ভূমিহীন। এ ক্ষেত্রে ভূমি ব্যবহার নীতি, শস্য উৎপাদনের নিরিখে ম্যাপিং এবং ভূমি প্রশাসনে পল্লী দারিদ্র বিমোচন গুরুত্ব পাওয়া সবিশেষ প্রয়োজন। সরকারি নীতিমালায় খাসজমি ও পানির উৎপাদনমুখী ব্যবহার প্রাধান্য পেতে পারে। বাংলাদেশে ৩০টি কৃষি ইকোলজিক্যাল জোন আছে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদিত হয়। ভূমির যথোপযুক্ত ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা (যা ১৯টি উপকূলীয় এবং ২টি সমতল জেলার জন্য করা হয়েছে), পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কর্তৃক উপকূলীয় ইকোসিস্টেম স্টাডি এবং ঝজউও কর্তৃক প্রণীত খাদ্য নিরাপত্তার নীতিসমূহ বাস্তবায়ন করা গেলে ভূমির আরও উৎপাদনমুখী ব্যবহার সম্ভব বলে মনে করেন অনেকেই।
তবে এতোসব নিরাশার মধ্যে আশার কথা হলো আবাদি জমির পরিমাণ কমলেও এক ফসলি ও অনাবাদি জমির রূপান্তর ঘটেছে দ্রুত। দেশের এখন দুই ফসলি জমি প্রায় ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ ও তিন ফসলি জমির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ২১ শতাংশ। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে শস্য উৎপাদনে।
জানা যায়, ১৯৮০ সালে এক ফসলি জমির পরিমাণ ছিল মোট আবাদি জমির প্রায় ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ। যা ১৯৯০ সালে ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশে, ২০০০ সালে ৩৪, ২০১০ সালে ৩০ দশমিক ১ ও ২০১৯ সালে ২৪ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসে। তবে এই সময়ে দুই ফসলি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ সালে দুই ফসলি জমির পরিমাণ ছিল মোট আবাদি জমির প্রায় ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ। যা ১৯৯০ সালে ৪০ দশমিক ১ শতাংশে, ২০০০ সালে ৪৭ দশমিক ১, ২০১০ সালে ২৬ দশমিক ৮ ও ২০১৯ সালে ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়।
এছাড়া, গত চার দশকের ব্যবধানে তিন ফসলি জমির পরিমাণ বেড়েছে। ১৯৮০ সালে তিন ফসলি জমির পরিমাণ ছিল মোট আবাদি জমির মাত্র ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। যা ১৯৯০ সালে ১০ দশমিক ১ শতাংশে, ২০০০ সালে ১১ দশমিক ৩, ২০১০ সালে ১৫ ও ২০১৯ সালে ২১ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়। দেশের ২৩টি অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তিন ফসলি জমির আবাদ বৃদ্ধি পচ্ছে খুলনা বিভাগে।
যে হারে কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে তারপরও দেশের ওপর খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব না পড়ার প্রধান কারণ দুটি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, প্রথমত অনাবাদি ও এক ফসলি জমিকে দ্রুত দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয়ত গত চার দশকের ব্যবধানে হেক্টরপ্রতি ফলন দ্রুত বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। উন্নত জাত উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কারণে হেক্টরপ্রতি ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।
তবে এটি স্পষ্ট যে, অল্প সংখ্যক জমিতে ফলন আরো বাড়াতে জমিতে আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি বাণিজ্যিক কৃষিকে উৎসাহিত করতে হবে। বিভিন্ন ফসলের স্বল্পমেয়াদি জাতসহ খরা, বন্যা এমনকি লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া কৃষিবিষয়ক সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে আরো সমন্বয় প্রয়োজন। গবেষণা ও সম্প্রসারণে দ্রুত সংযোগ ঘটাতে পারলে কৃষির উন্নয়ন টেকসই করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রতিনিয়ন বাড়ছে, এবং তার সাথে তাল মিলিয়ে কৃষি জমির সংখ্যা কমছে। কাজেই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সরকারের এখন থেকে কৃষিকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলার জন্য উঠেপড়ে লাগতে হবে।