গণপরিবহণে দুর্ভোগ শেষ হচ্ছে না। সাধারণ যাত্রীরা আবার বিপাকে পড়েছে। পরিবহণ ভাড়া এমনিতেই আদায় করা হচ্ছে বেশি। এখন আরও বেশি ভাড়া নির্ধারনের দাবি তুলেছে পরিবহণ মালিকরা। অথচ কিছুদিন আগেই পরিবহণ ভাড়া কমানোর জন্য চললো কঠোর দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন। ভাড়া নির্দিষ্ট হারে আদায়ের জন্য সমঝোতাও হলো। তাহলে তারপরও কেন এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়? কেন সাধারণ যাত্রীদের এভাবে সময়ে সময়ে ভাড়া নৈরাজ্যের কবলে পড়তে হবে?
সূত্র জানায়, বাস ও লঞ্চ মালিকরা আগের মতোই ভাড়া বৃদ্ধি চান। ফলে বাড়তি ভাড়ার জন্য কৃত্রিম সংকটের শঙ্কা জেগেছে। পাশাপাশি এমনিতেই কর্মদিবসে অফিস শুরু ও ছুটির সময়ে রাজধানীর বাসে আসন পাওয়াই দুস্কর। বাদুড়ঝোলা হয়ে যাত্রীরা বাসে চড়েন। আর যাত্রার পাঁচ দিন আগে বিক্রি শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফুরায় ট্রেনের টিকিট। এমন বাস্তবতায় আসনের অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী পরিবহনে যানবাহন সংকট হওয়া একপ্রকার নিশ্চিত।
করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কায় গণপরিবহণে অর্ধেক যাত্রী বহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভাড়া বৃদ্ধির সুর তুলেছে পরিবহণ মালিকরা।
এর আগে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ রোধের 'লকডাউনে' প্রথম দফায় ৬৮ দিন বাসসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ ছিল। সে বছর ১ জুন থেকে আসনের অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে বাস চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। মালিকদের প্রস্তাবে সেবার বাস ও লঞ্চের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। গত বছর দুই দফা 'লকডাউন'-এর পরও একই হারে ভাড়া বাড়িয়ে অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলেছিল বাস-লঞ্চ।
এরপর ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহণ মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে দেয় ব্যাপক হারে। জানা যায়, ডিজেলের দাম লিটারে এক লাফে ১৫ টাকা বাড়ায় গত ৮ নভেম্বর বাসের ভাড়া ২৭ থেকে ২৯ শতাংশ বেড়েছে। লঞ্চে ভাড়া ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলার শর্তের কারণে দুই মাসের ব্যবধানে ফের ভাড়া বাড়লে তা যাত্রীদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠবে বলে মন্তব্য করেছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেছেন, আগেও অর্ধেক সংখ্যক সিট খালি রাখার শর্ত মানা হয়নি। কিন্তু ৬০ শতাংশের পরিবর্তে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এবারও তা-ই হতে পারে। এর চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষায় কঠোর জোর দিয়ে আসনের সমান সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা দেওয়া উচিত।
বাসে অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের সরকারি নির্দেশনা কীভাবে কার্যকর করা হবে- এ নিয়েও একটা প্রশ্ন থেকে যায়।অর্ধেক যাত্রীর কথা যতোই বলা হোক না কেন শেষমেশ দেখা যাবে অধিকাংশ পরিবহণই তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।বলির পাঠা শেষমেশ হতে হবে ওই সাধারণ যাত্রীদের। ভাড়াও বেশি দিতে হবে, আবার নিরাপত্তা ঝুঁকিও মাথায় নিতে হবে।
অর্ধেক যাত্রী গ্রহণের ব্যাপারটি নিশ্চিত হলে সাধারণ যাত্রীদের যে দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া দিতে হবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এতে অল্প আয়ের চাকরিজীবীদের জন্য কষ্টকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। কেননা, আগেরবার অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলার শর্ত মানতে মালিকরা ৮০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল। পরে মন্ত্রণালয় ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির অনুমতি দিয়েছিল। পরিবহন মালিক সূত্র জানিয়েছে, অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলতে অন্তত ৫০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি চান তারা।
পরিবহণ মালিকরা যে অর্ধেক যাত্রী হলে বেশ ক্ষতির মুখে পড়ে যাবে এ নিয়ে ইতোমধ্যে হাহুতাস শুরু হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই আবার গরীব। এক দুটো বাস চালিয়ে সংসার চালায়। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, অর্ধেক সংখ্যক সিট খালি রাখলে মালিকের লোকসান হবে। লোকসান পোষাতে যতটা ভাড়া না বাড়ালেই নয়, ততটা বাড়াতে হবে।
অর্ধেক যাত্রী পরিবহণের সিধান্ত যে বাস্তবমুখী হবে না সে বিষয়ে একমত পোষণ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু খোলা রেখে গণপরিবহনে অর্ধেক সংখ্যক আসন খালি রাখার সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত নয়। এতে শুধু ভাড়া বাড়বে। বাস্তবে দেখা যাবে, যানবাহন সংকটের কারণে বাস যাত্রীবোঝাই হয়েই চলছে।
তাছাড়া রাজধানীতে বাসের তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। সরকার চাইলেও এই সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম। জানা যায়, রাজধানী ও আশপাশের রুটে চলাচলকারী বাস সংখ্যা সোয়া ছয় হাজার। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, দৈনিক চার থেকে সাড়ে হাজার বাস চলাচল করে। যা সকালে ও বিকেলে 'পিক আওয়ারে' পর্যাপ্ত নয়। লোকাল হিসেবে চলা বাসে দাঁড়ানোসহ আসনের দেড় থেকে দুই গুণ যাত্রী থাকে। অর্ধেক সংখ্যক আসন খালি রাখলে পিক আওয়ারে তিন থেকে চার গুণ বাস লাগবে।
বিশেষজ্ঞরাও এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোন পথ দেখছেন না। তাঁদের মতে, করোনা সংক্রমণ রোধে বাসে ভিড় কমাতে অর্ধেক সংখ্যক আসন খালি রাখার সিদ্ধান্ত ভালো। কিন্তু কীভাবে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে, তা বোধগম্য নয়। আগেও এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। অর্ধেক সংখ্যক সিট খালি রাখলে যান সংকট কীভাবে দূর করা হবে, তার নির্দেশনা নেই। তাছাড়া অর্ধেক সংখ্যক সিট খালি রাখলে ভাড়া বাড়াতে হবে। যাত্রী ও মালিক- উভয় পক্ষই করোনার কারণে আর্থিকভাবে নাজুক অবস্থায় রয়েছেন। তাই যাত্রীর ওপর বাড়তি ভাড়ার বোঝা না চাপিয়ে সরকারকেই প্রণোদনা দিতে হবে।
বাজারে ডিজেলের দাম যখন স্থিতিশীল ছিল তখন মিরপুর-১০ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসে ভাড়া ছিল ২০ টাকা। এখন ২৬ টাকা হয়েছে। অর্ধেক সংখ্যক আসন খালি রাখার কারণে ভাড়া যদি ৫০ শতাংশ বাড়ে তাহলে ভাড়া হবে ৩৯ টাকা। অর্থাৎ ভাড়া দুই মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এ ছাড়া আগের বিধিনিষেধ চলাকালে অ্যাপভিত্তিক গাড়িতেও আসনের অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলার নিদের্শনা দেওয়া হয়েছিল। বন্ধ ছিল মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন। এবারও এমন সিদ্ধান্ত আসবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না।এমন সিদ্ধান্ত এলে বাসের ওপরই চাপ পড়বে। ফলে অর্ধেক যাত্রী বহনের ব্যাপারটি কোনভাবেই বাস্তবায়িত হবে না। দেখা যাবে বাসে যাত্রীও যাচ্ছে বেশি, আবার ভাড়াও আদায় করা হচ্ছে বেশি।