জনপ্রতিনিধিদের কাতারে তৃতীয় লিঙ্গের সংখ্যা বাড়ছেই। সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ ও শৈলকুপাতে তৃতীয় লিঙ্গ- (হিজড়া সম্প্রদায়ের) দুইজন সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিগত দু’বছর আগে কোটচাঁদপুর উপজেলাতে উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে তৃতীয় লিঙ্গের এক সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। এ নিয়ে ঝিনাইদহ জেলাতেই তিনজন সদস্য বিজয়ী হয়ে জনপ্রতিনিধির কাতারে শরিক হলেন।
এ পর্যন্ত ঝিনাইদহ জেলাতে তৃতীয় লিঙ্গের নির্বাচিতরা হলেন, কালীগঞ্জ উপজেলার ৬ নং ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নজরুল ইসলাম ঋতু, শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি ইউনিয়নের ১,২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে শম্পা খাতুন পপি ও কোটচাঁদপুর উপজেলার উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পিংকি খাতুন। বিজয়ী ফলাফলে দেখা গেছে এরা ভোট সংখ্যায় ও বেশ রেকর্ড গড়ে চমক সৃষ্টি করেছেন। নৌকাকে পেছনে ফেলে ডাবল ভোটের ও বেশি, কেউ আবার তার প্রতিদ্বন্দি সব প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ের রেকর্ডও গড়েছেন।
তাদের প্রাপ্ত ভোট সংখ্যার এক বিশ্লেষনে দেখা গেছে, গেল বছরের ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কালীগঞ্জের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নজরুল ইসলাম ছানাকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতু পান ৯৫৫৭ ভোট। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দি নৌকা প্রতীকের নজরুল ইসলাম ছানা পায় ৪৫২৯ ভোট। সে হিসাবে নৌকার প্রাপ্ত ভোটের থেকেও ডাবলেরও বেশি ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ঋতু।
উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের মৃত আবদুল কাদেরের সন্তান ঋতু ঢাকাতে থাকলেও প্রায়ই গ্রামে আসেতেন। দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে থেকে তার সহায়তা অব্যাহত ছিল। এরপর সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি ইউনিয়নের ১,২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে মোছা. শম্পা খাতুন পপি হেলিকপ্টার প্রতীকে ২১০১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার প্রতিদ্বন্দি প্রার্থী সাবিহা খাতুন ৫১৪ ভোট ও লিলি খাতুন পান ৩২৫ ভোট। শম্পার প্রাপ্ত ভোট সংখ্যার বিশ্লেষনে দেখা গেছে প্রতিদ্বন্দি দুই প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়েও শম্পা ৩ গুন ভোট বেশি পেয়ে রেকর্ড গড়েন। তৃতীয় লিংগের শম্পা ওই ইউনিয়নের ফুলহরি গ্রামে বসবাস করেন। তার জন্মস্থান মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া গ্রামে। সে আড়পাড়া গ্রামের শেখ রুহুল হাওলাদারের চতুর্থ সন্তান। তার আরো দুই ভাই ও দুই বোন রয়েছে। ২০০৬ সালের দিকে সে পরিবার ছেড়ে শৈলকুপার ফুলহরি গ্রামে চলে আসেন। শম্পা ২০১৩ সালে উচ্চমাধ্যমিকপাশ করেন।
দু’বছর আগে ঝিনাইদহের কোটচাদপুর উপজেলার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে তৃতীয় লিংগের সাদিয়া আক্তার পিংকি বিজয়ী হয়েছিল। পিংকি ১২ হাজার ৮৮০ ভোট পেয়েছিল,তার নিকটতম ছিলেন রিনা খাতুন ১২ হাজার ১৩৯ ভোট। পিংকি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। সে কোটচাঁদপুর উপজেলা মহিলা যুবলীগের আহব্বায়ক। পিংকি কোটচাদপুর উপজেলার দোড়া ইউনিয়নের সোয়াদি গ্রামের নোয়াব আলীর সন্তান। এভাবে ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন উপজেলাতে জনপ্রতিনিধিদের কাতারে যোগ হচ্ছে তৃতীয় লিংগের জনগোষ্ঠী। এ পর্যন্ত জেলায় তৃতীয় লিঙ্গের ৩ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ায় সারাদেশের মধ্যে ঝিনাইদহ জেলা সকলের কাছে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে।
সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে নির্বাচিত চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম রিতু ও মহিলা সদস্যা শম্পা খাতুন তাদের বিজয়ের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, এ বিজয় আমাদের নয়, জনগণের। কারণ আমরা তো একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। সমাজে আমাদের সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা একেবারেই নগণ্য। তারপরও এলাকার জনগণ আমাদেরকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছেন। এখন সবাই আমাদের আপনজন। আমরা বুঝতে পারছি না কিভাবে তাদের ঋণ শোধ করবো। আর নির্বাচিত হবার পর দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেল। তারা বাকি জীবনটা ভোটারদের জন্য উৎসর্গ করতে চান। পাশাপাশি এলাকার উন্নয়নে সকলের সহযোগিতা চান বলেও যোগ করেন ওই তৃতীয় লিংগের দুই সদস্যা।
এমন বিজয়ে কালীগঞ্জের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নে নির্বাচিত নজরুল ইসলাম ঋতুর এলাকার সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের সাগর হোসেন জানান, ঋতু আমাদের এলাকারই সন্তান। পেশাগত কারণে ঢাকাতে থাকলেও সে প্রতিনিয়ত এলাকায় এসে অসহায় মানুষের জন্য কাজ করেন। তার উদার মনের সহযোগীতার কারণেই মানুষ তাকে ভালবেসে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন।
অপরদিকে শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি ইউনিয়নের ১,২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে মোছা. শম্পা খাতুন পপির আসনে বাদশা নামের এক ভোটার জানান, শম্পা দীর্ঘদিন এখানে থাকার ফলে সবার সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আচার ব্যবহারেও সে খুব ভদ্র যে কারণে এবারে এলাকার মানুষ তাকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছেন।