পুরান ঢাকাবাসীর ঐতিহ্যবাহী উৎসব সাকরাইন। পৌষসংক্রান্তি উৎসব বা এই সাকরাইনকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরের মত এবারও উৎসবের আমেজে সাজে পুরান ঢাকা। তবে, পুরান ঢাকার ঐতিহ্য অনুযায়ী ঘুড়ি উড়িয়ে দিবসটি পালন করার কথা থাকলেও বিগত কয়েক বছর ধরে ঘুড়ির বদলে বিভিন্ন ভবনের ছাদে আয়োজন করা হয় “ডিজে পার্টি”র। আর এসব পার্টিতে বাজানো উচ্চ শব্দের গানের আওয়াজে অতিষ্ঠ হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। একটা সময় ছিল, যখন সাকরাইন উৎসব মানেই পুরান ঢাকার ঘরে ঘরে পৌষের পিঠার ধুম পড়তো। তরুণ-তরুণীরা নতুন পোশাক গায়ে জড়াতো। সারাদিন ঢাকার আকাশে উড়তো ঘুড়ি। কিন্তু সময় বদলে গেছে। সাকরাইন উৎসবও এখন ঢুকে পড়েছে আতশবাজি আর ডিজে পার্টিতে। সারাদিন ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব চললেও ঠিক সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই আতশবাজি, বাজি আর ডিজে গানের শব্দে কেঁপে ওঠে পুরান ঢাকা। উৎসবে বাজি আর ডিজের কান ফাটানো শব্দে অনেকেই বিরক্ত। থার্টি ফাস্ট নাইটে বাজির শব্দে হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুসহ এক নারীর মৃত্যুর খবর দাগ কেটেছিল মানুষের মনে। এ ছাড়া ফানুসের আগুনে একইসাথে ১০ জায়গায় অগ্নিকা-ের ঘটনাও ঢাকাবাসীর অজানা নয়। এরপর থেকে দাবি উঠে, ফানুস আর আতশবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এরইমধ্যে এলো সাকরাইন উৎসব। এদিন ফানুস উড়ানো কম দেখা গেলেও আতশবাজি ও ডিজে গানেই উদযাপন হয় উৎসব।
বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় স্পষ্ট বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কী ধরনের শব্দ দূষণ করা আইনত দ-নীয় অপরাধ। শব্দ দূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক। আর বিশেষ করে ঢাকা শহরে শব্দ দূষণের বহু উৎস রয়েছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্পকারখানা কোন ক্ষেত্রেই শব্দ দূষণ বিষয়ে যেসব নিয়ম রয়েছে তা মানা হচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে সেখানে বিস্তারিত বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কোন ধরনের শব্দের মাত্রা কেমন হবে। আর তা না মেনে চললে সাজার বিধানও রয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। বাংলাদেশে মাইকের ব্যাবহার খুবই জনপ্রিয়। বেশ কিছুদিন যাবত লাউড স্পিকারও ব্যবহার হচ্ছে। রাজনৈতিক সভা থেকে শুরু করে বিয়ে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পিকনিক সকল ক্ষেত্রে এর কানফাটানো শব্দ চলে। তবে আইনে শর্ত সাপেক্ষে এর অনুমতিও রয়েছে। খোলা জায়গায় বিয়ে, খেলাধুলা, কনসার্ট ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক বা অন্য কোন ধরনের সভা, মেলা, যাত্রাগান ইত্যাদির ক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা অতিক্রম করে Ñএমন যন্ত্র ব্যাবহার করা যাবে। তবে তার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে, পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় এই শব্দ করা যাবে না এবং রাত দশটার মধ্যে এসব অনুষ্ঠান অবশ্যই শেষ করে ফেলতে হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখে পৌষ-সংক্রান্তি বা সাকরাইন উৎসবের দিন বিকট শব্দের আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারির করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। উৎসব-উদযাপনে আনন্দ হবেই। কিন্তু এর পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে তা যেন অন্যের বিষাদের কারণ না হয়। শব্দ দূষণ বন্ধে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।