রেড জোনে থাকা শিক্ষা নগরী খ্যাত বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে আবারও করোনা সংক্রমণের চূড়ায় উঠতে শুরু করেছে। সর্বশেষ রোববার (২৩ জানুয়ারি) নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে রাজশাহী জেলায় করোনা সংক্রমণের হার এসেছে ৬০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর আগের দিন ছিল ৪৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। তার আগের ২৪ ঘন্টায় (২১ জানুয়ারি) এখানে করোনা সংক্রমণের হার ছিল ২৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। আর সর্বোচ্চ সংক্রমণের দিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন আরও তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। করোনা ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই যেন উচ্চ ঝুঁকিতে পড়েছে বিভাগীয় শহর রাজশাহী। এমন পরিস্থিতিতে টিকা নেওয়ার পাশাপাশি সকলকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ দিয়েছেন এখানকার চিকিৎসকগণ। আর সংক্রমণের হার এভাবে বাড়তে থাকলে যে কোন সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে।
সোমবার (২৪ জানুয়ারি) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দৈনন্দিন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় রামেক হাসপাতালে মারা যাওয়া তিন জনই রাজশাহী জেলার বাসিন্দা। এদের মধ্যে একজন করেনা পজিটিভ থাকলেও অন্য দুজন রোগটির উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। মৃত পরিবারের অভিভাবকদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মরদেহ দাফনের নির্দেশনা দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এ তথ্য নিশ্চিত করে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী সোমবার দুপুরে জানান, মৃত তিন জনের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী রয়েছে। আর সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত করোনা ইউনিটে থাকা ১০৪ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিলেন ৫১ জন। এদের মধ্যে করোনা পজিটিভ ৩৫ জনের। আর অন্যরা করোনার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন। ভর্তি রোগীদের মধ্যে রাজশাহী জেলার ২৪ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৬ জন, নওগাঁর ৫, নাটোরের ৩, পাবনার ৫, বগুড়ার ১, কুষ্টিয়ার ৪, চুয়াডাঙ্গার ১, সিরাজগঞ্জের ১ এবং জয়পুরহাটের ১ জন।
হাসপাতাল পরিচালক জানান, রোববার (২৩ জানুয়ারি) রামেক হাসপাতালের আরটি-পিসিআর ল্যাবে ৯২ জনের নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে ৫৬ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে। আর রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ল্যাবে ৩৬৬ জনের নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে শনাক্ত হয়েছে ১৭২ জনের। অর্থাৎ এদিন মোট ৪৫৮ টি নমুনা পরীক্ষায় ২২৮ ব্যক্তির করোনা শনাক্ত হয়েছে। এই ২২৮ ব্যক্তির মধ্যে রাজশাহী জেলারই ১৬৬ জন। বর্তমানে নমূনা পরীক্ষার ফলাফলে রাজশাহীতে অর্ধেকেরও বেশি মানুষের করোনা সনাক্ত হচ্ছে। সর্বশেষ ফলাফলে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রাজশাহী জেলায় করোনা শনাক্তের হার এসেছে ৬০ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
সার্বিক বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) নাজমা আক্তার জানান, হঠাৎ করে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। আর বিভাগের মধ্যে আবার রাজশাহী জেলাতেই করোনার সংক্রমণ বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ কারণে এখন সকলকেই সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করতে হবে। আর এমন পরিস্থিতিতে টিকা নেওয়ার পাশাপাশি সকলকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। নয়তো, পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
জানা গেছে, রাজশাহীতে ওমিক্রন শনাক্তের কোনো ব্যবস্থা নেই। তারপরেও চিকিৎসকদের ধারণা, এটি করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবেই হচ্ছে। এভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে চিকিৎসা সংকট আগের চেয়েও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এরপরও সাধারণ মানুষ মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উদাসীন। তাই রাজশাহী বিভাগে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে ডেল্টা ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঘোষণা মতে হলুদ থেকে লাল জোনে প্রবেশ করেছে রাজশাহী। এরপরও বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি না মানায় বেড়েই চলেছে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তবে সংক্রণের হার বাড়লেও আপাতত সেভাবে রোগটিতে মৃত্যু বাড়েনি।
এর আগে গত বছর দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর মৃত্যু ও সংক্রমণের দিক থেকে শীর্ষে উঠেছিল ‘রাজশাহী’। সে সময় করোনার ডেল্টা ভেরিয়েন্টে এখানে একদিনে সর্বোচ্চ ২২ জনের প্রাণহানীও ঘটেছে। তাই আগের অভিজ্ঞতায় এবারের ঢেউয়ে এমনটি যেন না হয় এমন কথা বললেও রাজশাহীতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন বালায় দেখা যাচ্ছে না। ফলে রাজশাহীর সচেতন মহলে আবারও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করলেও এ বিষয়ে অধিকাংশ জনসাধারন রয়েছে অন্ধকারে।
এদিকে, সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী রাজশাহীতে এ পর্যন্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৬৮ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৮৫ জন। আর সিনোফার্ম টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৮ লাখ ৪৯ হাজার ৬০৬ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৫ লাখ ২ হাজার ৩৩৪ জন। এছাড়াও মডার্নার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ২ লাখ ২ হাজার ১৩৫ জন। ফাইজার টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৪২ হাজার ৮২৯ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১ হাজার ৬০৬ জন। বর্তমানে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে।