পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কাশিনাথপুরে স্কাইলার্ক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মূল ফটকের বাইরে রাস্তার পাশে গড়ে উঠেছে ভিন্নধর্মী এক পাঠাগার। নাম- স্কাইলার্ক পথপাঠাগার। এখানে রেজিস্টারে নিজের নাম, ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে পথচারীরা ইচ্ছেমতো বিনামূল্যে পছন্দের বই বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। বই নিলে সেটি পড়ে ফেরত দিতে হয়। সেই সাথে নিজের কাছে থাকা নতুন বা পুরাতন বই পাঠাগারে দান করার আহবানও করা হয়েছে পাঠাগারের পক্ষ থেকে। দেশের বাইরে এমন অনেক পাঠাগার দেখা গেলেও বাংলাদেশে এমন উদ্যোগ বিরল। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকেই এই পথপাঠাগারের যাত্রা শুরু হয়। কাশিনাথপুরের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্কাইলার্ক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অর্থায়নে সাংবাদিক, গীতিকার ও শিক্ষক আলাউল হোসেন এই পথপাঠাগারটি গড়ে তোলার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আর এ কাজে তাকে পূর্ণ সহায়তা দিয়ে এগিয়ে আসেন স্কাইলার্ক স্কুলের সভাপতি প্রভাষক সালাহউদ্দিন আহমেদ ও আরেক পরিচালক ফজলুর রহমান। আলাউল হোসেন তার নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহের নতুন পুরোনো প্রায় শতাধিক বই দিয়ে পাঠাগারটি শুরু করেন। পরবর্তীতে স্থানীয় কলি প্রকাশনীর কর্ণধার ও কাশিনাথপুরের প্রয়াস পাবলিক লাইব্রেরীর সেক্রেটারী দুই শতাধিক বই এই পথপাঠাগারে দান করেন। এরপর থেকে এলাকার অনেক সচেতন মানুষ দুইচারটি করে বই দিয়ে পাঠাগারটিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। প্রতিষ্ঠার ৫ দিনের মাথায় এখন পাঁচ শতাধিক বই রয়েছে পাঠাগারে। প্রতিদিন ৫০-৬০ জন করে পথচারী নিজেদের পছন্দের বই পাঠাগার থেকে নিয়ে যাচ্ছেন এবং পড়া শেষে আবার ফেরত দিয়েও যাচ্ছেন। জানা যায়, পথচারী পাঠকদের অধিকাংশই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। তাই উদ্যোক্তারা তাদের উদ্যোগটি ফলপ্রসূ হচ্ছে বলেই ধারণা পোষণ করেছেন।
স্বেচ্ছাসেবক হয়ে পথপাঠাগারটি সার্বক্ষণিক দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করছেন পাঠাগারের পাশে অবস্থিত শিরিন স্টোরের সত্ত্বাধিকারী সুরুজ আলী ও আস্থা ম্যাগাশপের ম্যানেজার আবির মাহমুদ স¤্রাট। এ ছাড়া আশপাশে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থীও স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পাঠাগারটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। সকালে চাবি দিয়ে খোলা ও সন্ধ্যার পরে চাবি দিয়ে পাঠাগারের গ্লাস বন্ধ করে দেন স্বেচ্ছাসেবকরা। আর এ কাজটি স্বেচ্ছাসেবকরা আনন্দের সাথেই করে যাচ্ছেন। পাঠাগারের আশেপাশের দোকানমালিকরাও অবসরে পাঠাগার থেকে বই নিয়ে পড়াশুনা করছেন। অদ্ভূত এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে পাঠাগার এলাকায়।
পথপাঠাগারের উদ্যোক্তা স্কাইলার্ক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও বেড়া উপজেলার মাশুন্দিয়া-ভবানীপুর কেজেবি ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক আলাউল হোসেনের সাথে তার পরিকল্পিত পথপাঠাগার নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, মানব জীবনের ব্যর্থতা, শূন্যতা ও হতাশা থেকে পরিত্রাণের অন্য কোন উপায়ই নেই একমাত্র বইপড়া ছাড়া। আমাদের সময় অ্যাকাডেমিক লেখাপড়ার পাশাপাশি সৃজনশীল (গল্পের বই) পড়ে অথবা খেলাধূলা করে সময় কাটাতো অধিকাংশ শিক্ষার্থী। এখন সেই জায়গা দখল করেছে ফেসবুক, স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট, ইউটিউব প্রভৃতি। এতে শিক্ষার্থীদের মননশীল চর্চা একেবারেই কমে গেছে। ফেসবুক, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ইউটিউবসহ অন্য সব সামাজিক মাধ্যমগুলোর অবাধ অপব্যবহার এই প্রজন্মকে অসহনশীল, অশালীন, অমার্জিত এমনকি অসামাজিক করে গড়ে তুলছে। নতুন প্রজন্মকে এই পথ থেকে ফেরানোর একটাই উপায়- বইপড়ানো। পঠন-পাঠন ছাড়া তরুণদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করানো যাবে না। এই দিক বিবেচনায় আমি পথপাঠাগারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। পাঠাগারটি শুরুর পরে গত ৫ দিনে শতাধিক পাঠক বই নিয়ে গেছে। যাদের অধিকাংশ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাড়া জাগাতেই স্কুল-কলেজে যাতায়াতের জন্য কাশিনাথপুরের সবচেয়ে ব্যস্ততম রাস্তার ধারে পাঠাগারটি স্থাপন করেছি। আগামীতে এর পরিসর বাড়ানো হবে। সহযোগী পেলে আমি আমার নিজ জেলা পাবনার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে পথপাঠাগার গড়ে তুলতে চাই।
স্কাইলার্ক স্কুলের সভাপতি মো. সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মানুষকে আলোকিত করার স্বপ্ন দেখাতেই এই পথপাঠাগারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একটি তথ্যনির্ভর ও আধুনিক সমাজ বির্নিমাণে নতুন প্রজন্মকে বইপড়ায় সম্পৃক্ত করতে পারলে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব সহজেই।
আরেক উদ্যোক্তা ফজলুর রহমান বলেন, স্কাইলার্ক পথপাঠাগার অত্র এলাকার বেশ কিছু তরুণের মধ্যে ইতোমধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই যেভাবে পাঠকের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে- সত্যিই অবিশ্বাস্য।
পাঠাগারের পাশেই অবস্থিত মীর ইলেক্ট্রিকের মালিক মীর আবদুল বারেক বলেন, ‘পাঠাগার মানেই কিছু নিয়ম কানুন থাকে, কিন্তু এই পাঠাগারটি সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে বই নিতে বা ফেরত দিতে কারও শরণাপন্ন হতে হবে না। নেই কোন সময়ের সীমাবদ্ধতা। এরকম একটি আয়োজন আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশেই, ভাবতেই চমৎকার লাগছে। অবসরে দোকানে বসে পছন্দের বই পড়তে পারছি।’
’বোধোদয়ের আন্দোলনে স্কাইলার্ক পথপাঠাগার’ শ্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাওয়া পথপাঠাগারের জন্য বানানো সেলফে দুই হাজারের অধিক বই ধরবে বলে জানান উদ্যোক্তারা। প্রায় ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে সেলফটি তৈরি করা হয়েছে। বৃষ্টি হলে যাতে পানি না ঢোকে সেজন্য মোটা থাই গ্লাস দেয়া হয়েছে সামনের বরাবর। উদ্যোক্তাদের মতে, পাড়ামহল্লায় এভাবে পথপাঠাগার বা ভ্রাম্যমান পাঠাগার গড়ে তোলা হলে তরুণপ্রজন্ম ভার্চয়াল ভাইরাস থেকে নিজেদের সহজেই মুক্ত করতে পারবে। আর এজন্য প্রথম ভূমিকা পালন করতে হবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের।