বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে এক ডজন আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন চলে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে। আর বর্তমানে দেশে করোনার ঊর্দ্ধোগতি কারণে বিধিনিষেধ আসার পর এসব ট্রেনের টিকিট চোখের পলকেই শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি কয়েকদিন ধরেই এসেছে আলোচনায়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দেশের মিডিয়া জগতেও চলছে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। অভিযোগ উঠেছে, রাজশাহী রেল স্টেশন ঘিরে থাকা কালোবাজারি চক্রের অপতৎপরতায় সাধারণ যাত্রীদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে টিকিট। আর এই সিন্ডিকেট চক্রে খোদ রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মমিনেরই জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। টানা কয়েকদিন অনুসন্ধান চালিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এছাড়াও অতি সম্প্রতি পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে নতুন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হিসাবে অসীম কুমার তালুকদার যোগদান করার পর টিকিট কালোবাজারি ধরতে তিনি নিজেই মাঠে নেমেছেন। স্টেশনে গিয়ে সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে টিকিটের খোঁজ নিচ্ছেন। এতে টিকিট কালোবাজারি চক্রের অনেক তথ্য মিলছে বলে জানা গেছে।
প্রাপ্ত অভিযোগ মতে, এই চক্রের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন মমিন ছাড়াও আরও গুটিকয়েক অসৎ বুকিং সহকারী। তবে সম্প্রতি এই চক্রকে ধরতে বিভিন্ন মহল থেকে পশ্চিমাঞ্চল রেল কর্তৃপক্ষসহ প্রশাসনকে তাগাদা দেওয়া হয়। এরপর অবস্থা বেগতিক দেখে গা-বাঁচাতে ছুটি নিয়েছেন সন্দেহভাজন মমিনসহ কয়েকজন বুকিং সহকারী।
সর্বশেষ শনিবার (২৯ জানুয়ারি) দুপুরে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, রাজশাহী রেল স্টেশনের কাউন্টারের দায়িত্বে আছেন ২৬ জন বুকিং সহকারী। এর মধ্যে প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মমিনসহ পাঁচজন এখন ছুটিতে। মমিন এ স্টেশনে বছরের পর বছর ধরে আছেন। এর আগে ২০১৯ সালে টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে তাকে রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জে বদলি করা হলেও ৬ মাসের ব্যবধানে আবারও ফিরে আসেন তিনি। আর তিনি তাঁর দুই জন সহযোগী বুকিং সহকারীকে নিয়ে টিকেট কালোবাজারী নেটওয়ার্ক গুছিয়ে রেখেছেন বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। আর কালোবাজারি চক্রের সন্ধানে মাঠে নামলে ছুটিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মমিন মূলত ৬ নম্বর কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করতেন। মমিন সারা দিন স্টেশনে না এলেও রাত ৮টা থেকে এ কাউন্টারে বসতেন।
অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, এই কাউন্টারে টিকিট নিতে যাওয়া অনেককেই মমিনের কাছে গিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির পরিচয় দেয়া মাত্রই তিনি টিকেট বের করে দিয়েছেন। তবে একই সময় লাইনে দাঁড়ানো অন্যদেরকে টিকিট নেই বলে ফিরিয়ে দিতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে বক্তব্য পেতে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া মাত্রই তিনি সেখান থেকে কোন প্রকার কথা না বলে সটকে গেছেন। পরে তার বক্তব্য পেতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি তার মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়েও মেলেনি কোনো উত্তর।
ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানান, সম্প্রতি দেশে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চালানোর নির্দেশ দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। টিকিট নিয়ে সংকট বহুদিনের হলেও রেল কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তের পর তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগায় টিকিট কালোবাজারি চক্র। বর্তমানে রাজশাহী স্টেশনে ট্রেনের টিকিট যাত্রার ৫ দিন আগে অনলাইনে ও স্টেশন কাউন্টারে বিক্রি করা হয়। এখন নির্ধারিত মোট আসনের ৫০ শতাংশ অনলাইনে এবং ৫০ শতাংশ কাউন্টারে বিক্রি করা হচ্ছে। সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, টিকিট বিক্রি শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। বিশেষ করে রাজশাহী থেকে ঢাকামুখী চারটি আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিটের ব্যাপক সংকট দেখা যায়।
এদিকে, অনলাইনে টিকিট নিতে যাত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর প্রয়োজন পড়ে। আর কালোবাজারি চক্র নানাভাবে অন্যান্যের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর সংগ্রহ করে অনলাইন থেকে টিকিট নামিয়ে নিচ্ছে। এসব টিকিটই কালোবাজারে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর ট্রেনে টিকিট যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকলেও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর যাচাইয়ের ব্যবস্থা না থাকায় সেই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে এই চক্রটি।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন টিকিট কালোবাজারিতে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে কৌশলে কথা বলে জানা গেছে, টিকিট কালোবাজারিদের সঙ্গে রাজশাহী নগরীর কয়েকটি কম্পিউটারের দোকান, বিমানের টিকিট বিক্রির দোকানসহ শিরোইল, মঠপুকুর, শিরোইল কলোনি ও দড়িখরবোনা এলাকার একদল যুবক জড়িত। তারা অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর সংগ্রহ করে অনলাইনে টিকিট সংগ্রহের পাশাপাশি রাজশাহী স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারীসহ আরও কয়েকজনের সহযোগিতায় দিব্যি চাহিদামতো টিকিট পেয়ে যাচ্ছেন। আর সেসব টিকিট তারা চড়া দামে বিক্রি করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা-রাজশাহী রুটে চারটি ট্রেন নিয়মিত চলাচল করছে। এই ট্রেনগুলোতে শোভন চেয়ারের ভাড়া ৩৪০ থেকে ৩৭৫ টাকা, স্নিগ্ধা চেয়ারের ভাড়া ৬৫৬ থেকে ৭২৫ টাকা। তবে দালালদের হাতে গেলেই তা হয়ে যায় যথাক্রমে ৪২০ থেকে ৪৫০ টাকা এবং ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। আর ৭৮২ থেকে ৮৬৫ টাকার কেবিনের ভাড়া হয়ে যায় ১ হাজার টাকা। বিশেষ দিন বা ঢাকায় সরকারি চাকরির পরীক্ষার তারিখ থাকলে কালোবাজারে এই টিকিটের দাম আরও বেড়ে যায়।
এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি নির্দেশনা মতো নির্ধারিত আসনের চেয়ে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচল করছে। টিকিট কালোবাজারি রোধে রেল কর্তৃপক্ষ তৎপর রয়েছে। এই কাজে রেলের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি রাজশাহী স্টেশনে টিকিট সংকট নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলে কালোবাজারি রোধে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নগর আওয়ামী লীগ নেতারা পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম), নগর পুলিশের কমিশনার ও র্যাব-৫ এর পরিচালক বরাবর লিখিত আবেদন দেন। এরপর পশ্চিম রেলের নতুন জিএম অসীম কুমার তালুকদার রেলের টিকিট কালোবাজারি বন্ধে তৎপরতা শুরু করেন।