শুস্ক মৌসুম শুরুর সাথে সাথে রাজশাহী অঞ্চলে শুরু হয়েছে পুকুর খননের মহোৎসব। সেই সাথে অবৈধভাবে বিক্রি করা হচ্ছে আবাদি জমির উপরের মাটি (টপ সোয়েল)। যা কেটে নিয়ে গিয়ে ইটভাটাসহ ভরাট কাজে ব্যবহার করছে এক শ্রেণীর অসাধু চক্র।
জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বা এলাকার প্রভাবশালী স্থানীয়রা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে মাটি বিক্রি ও পুকুর খনন করছে। ফলে দিন দিন রাজশাহী অঞ্চলে আবাদি জমি কমে গিয়ে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করার কারণে তা পরিবহনের সময় নষ্ট হচ্ছে রাস্তা-ঘাটও। এতে চরম দুর্ভোগ পোয়াতে হচ্ছে পথচারিদের।
জানা গেছে, রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী, পবা, পুঠিয়া, দূর্গাপুর, চারঘাটসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলায় প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় এসব অবৈধভাবে পুকুর খনন ও মাটি বিক্রির মহোৎসব চলমান রয়েছে। বিশেষ করে গোদাগাড়ী উপজেলার অন্তত ২০/২৫টি এলাকায় চলছে অবৈধ মাটি বিক্রি ও পুকুর খনন। স্থানীয়রা প্রশাসনকে অবগত করলে লোক দেখানো ভাবে এসব পুকুর খননকারিদের নিষেধ করে গেলেও রাতের আঁধারে তা অব্যহত রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের চাপাল এলাকায় ভেলারাবিল এলাকায় প্রায় ৪ বিঘা আবাদি জমি কেটে পুকুর খনন করা হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিধিরা। একই ইউনিয়নের পুরাখালি ও ভাগাইল এলাকায় পুকুর খনন করছে রাজশাহী নগরীর কর্ণহার এলাকার নাহিদ নামের একজন।
এছাড়াও ছয়ঘাটি, ঈশ্বরীপুর, শুনিতলা ব্রিজের নিচে বিলে, ঘুনকি ডাইং, দোতরাপুরা বোনা, চৈতন্যপুর, ভোলারবিলে মোজায় পুকুর খনন ও জমির উর্বর মাটি কাটা হচ্ছে। এছাড়াও রিশিকুল ইউনিয়ন ও মাটিকাটা ইউনিয়ন, মোহনপুর ইউনিয়ন ও গোদাগাড়ী ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় পুকুর খনন ও মাটি ভরাটের কাজ চলছে।
জানা যায়, কিছুদিন আগে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দিনের বেলা প্রকাশ্যে মেশিন নামিয়ে পুকুর খনন ও জমির মাটি কাটা হচ্ছিল। প্রশাসনের বাধায় তা বন্ধ করে দেয়। তবে প্রশাসনের ও স্থানীয়দের চোখ ফাঁকি দিতে কৌশল হিসেবে রাত ১০ টা হতে ভোর রাত পর্যন্ত পুকুর খনন চলছে। আবার রাতেই জমির মটি কেটে নিয়ে ট্রাক্টর ও ট্রলিতে করে মাটি বহন করে নিয়ে বিভিন্ন ইটভাটা ও রাস্তার উন্নয়ন কাজের বালির পরিবর্তে মাটি দিয়ে কাজ করছে।
দেওপাড়া ইউনিয়নের এক আদিবাসী জানান, পুকুর খনন ও মাটি কাটার বিষয়ে কিছুদিন আগে প্রশাসনকে জানানো হয়েছিলো তারা এসে নিষেধ করে গিয়েছিলো তবে তাদেরাই ইশারায় এসব খনন কাজ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। দিনের বেলা পুকুর খনন না করলেও খননের বড় বুল্টলাইজার মেশিন জমিতে পড়ে থাকছে। গভীর রাতে পুনরায় সেই খনন কাজ চলছে।
সূত্রমতে, এক শ্রেণীর মাটি ব্যবসায়ী অসাধু ভূমিদস্য চক্র খাস জমির আশপাশে নিজেরা জমি কিনে প্লট আকারে বিক্রির ব্যবসা করছে। তার প্লট তেরী করার সময় ক্রয়কৃত জমির সাথে খাসজমি প্লট করে দিয়ে বেশী দামে বিক্রি করছে। আর এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধিদের ছায়া। এই চক্রটি বেশী গোদাগাড়ী পৌর এলাকা, সুলতানগঞ্জ, লালবাগ হেলিপ্যাড, গোদাগাড়ী ইউনিয়নের জলাহার, মধ্য শায়লা, রেল লাইনের বসতি এলাকায় এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। খাস জমি দখল ও পুকুর ভারাট করার অপরাধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাদের জেলা জরিমানাও করছে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, জেলায় মোট জমির পরিমাণ ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৩১ হেক্টর। এক শতাংশও আবাদযোগ্য পতিত জমি নেই। ২০০৭-২০০৮ সালেও জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৯১ হাজার ৭৮০ হেক্টর। ২০১২-২০১৩ মেয়াদে তা গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৯০ হাজার ৮১০ হেক্টরে। এখন আবাদযোগ্য জমি রয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৮ হেক্টর। এক দশকে আবাদযোগ্য জমি কমেছে ৩ হাজার হেক্টরের উপরে। এর একটি বড় অংশ চলে গেছে বাণিজ্যিক পুকুর খননে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই। তারপরও এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি নানান কৌশলে পুকুর খনন করে যাচ্ছে।
গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী মো: জানে আলম বলেন, প্রতিনিয়ন আমরা এসবের বিরুদ্ধে অভিযান ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। আমি বর্তমানে করোনা আক্রায় হওয়ায় মাঠে যেতে পারছি না। এসিল্যান্ডও ট্রেনিং এ বাইরে আছে। দুদিন আগেই পুকুর খনন ও খাসমাটি দখল ও পুকুর ভরাটের জন্য একজনকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়াও একজনকে দুই মাসের সাজা প্রদান করা হয়েছে।
তবে তিনি বলেন, এই পুকুর খনন বা মাটি ভরাটের জন্য সরকারের পক্ষ হতে কোন আইন নেই তাই আমাদেরও খুব শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়না। তবে আমরা আমাদের অভিযান অব্যহতি রেখেছি বলে জানান।