ছেলের শ্বশুরবাড়ির লোকদের ফাঁসাতে বাসায় বেড়াতে আসা ভায়রার নয় বছরের নাতী ইয়াছিনকে জবাই করে হত্যা করে কাজী সিরাজুল ইসলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যার পর এলাকায় নিখোঁজের মাইকিংও করিয়েছেন তিনি। এমনকি লাশ উদ্ধারের সময়ও পুলিশের সাথে ছিলেন। তবে শেষ রক্ষা হলোনা। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে হত্যার রহস্য।
সোমবার সকালে ইয়াছিন হত্যার রহস্য উদঘাটনে তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আজিমুল করিম জানিয়েছেন, রোববার সন্ধ্যায় বিচারকের সামনে হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক বর্ননা করে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী দিয়েছেন একটি গরুর খামারের দিনমজুর হত্যাকারী কাজী সিরাজুল ইসলাম।
ওসি আরও জানান, শনিবার সকালে নগরীর রূপাতলী বসুন্ধরা হাউজিং এলাকা থেকে শিশু ইয়াছিনের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধারের পর রাতে নিহতের বাবা সিএনজি চালক মোঃ ছগির বাদী অজ্ঞাতনামা ব্যাক্তিদের আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় কাজী সিরাজুল ইসলামকে গ্রেফতার দেখিয়ে রোববার বিকেলে আদালতে সোপর্দ করা হয়। সন্ধ্যায় বিচারকের সামনে হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দেয় সিরাজ। পরবর্তীতে আদালতের বিচারক সিরাজুল ইসলামকে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
সূত্রমতে, আট মাস পূর্বে সিটি কর্পোরেশনের ২৫ নং ওয়ার্ডস্থ সোহরাফ খান হাউজিংয়ের দিনমজুর জাকির সরদারের মেয়ে ইতি আক্তারের সাথে সামাজিকভাবে বিয়ে হয় কাজী সিরাজুল ইসলামের ছেলে আলামিনের। বিয়ের কয়েকদিনের ব্যবধানে উভয়ের মধ্যে দাম্পত্য কলহের কারণে চারবার সালিস বৈঠকও হয়েছে।
ইতি আক্তার জানান, কয়েকদিন আগেও আলামিন তাকে মারধর করলে সে অচেতন হয়ে পরে। পরবর্তীতে বিয়ের মধ্যস্থতাকারী স্বপন মোল্লার মাধ্যমে সর্বশেষ সালিস করে তিনি তার বাবার বাসায় চলে আসেন। ইতির দাবি, যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় আলামিন তাকে মারধর করতো।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, ইতির বাবা জাকির সরদার বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করেছেন সিরাজুল ইসলাম ও তার ছেলে আলামিনের বিরুদ্ধে। ওই মামলা থেকে রেহাই পেতে পাল্টা মামলা দায়ের করার জন্য সিরাজুল পরিকল্পিতভাবে তার ভায়রার নাতী ইয়াছিনকে গলা কেটে হত্যা করেছে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, গত সোমবার বরগুনার বদরখালি ইউনিয়নের ফুলঝুড়ি গ্রামের বাসিন্দা ছগির হোসেনের ছেলে ইয়াছিন তার দাদি শিরিন বেগমের সাথে রূপাতলী ২৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা নিকট আত্মীয় সিরাজুল ইসলামের বাসায় বেড়াতে আসেন। ইয়াছিনের মা বিদেশে থাকেন। এ কারণে তাকে ডিভোর্স দিয়ে ছগির মনোয়ারা বেগম নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। ছগির রাজধানীর মহাখালীতে থেকে সিএনজি চালিয়ে সংসার চালান। আর ইয়াছিন তার দাদির সাথে বরগুনায় থাকে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইয়াছিন বাসায় আসার পরেই সিরাজুল পরিকল্পনা করেন শিশুটিকে হত্যা করে দায় চাপাবেন ছেলে আলামিনের শ্বশুর ও তাদের স্বজনদের ওপর। এমনকি বাদী হয়ে মামলা দেওয়ারও পরিকল্পনা ছিলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী শুক্রবার জুম্মার নামাজের আগে কৌশলে বসুন্ধরা হাউজিংয়ের মধ্যে বরিশাল রেডিও সেন্টারের দেয়াল সংলগ্ন একটি নির্জনস্থানে শিশু ইয়াছিনকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার পরিত্যক্ত একটি টয়লেটের স্লাবের ওপর পরিকল্পিতভাবে শুইয়ে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে ইয়াছিনকে জবাই করা হয়। পরে দিনভর বৃষ্টি হলে রক্ত ও পায়ের চিহ্ন মুছে যায়।
অপরদিকে সিরাজুল ইয়াছিনকে হত্যা করে বাসায় ফিরে ঠান্ডা মাথায় বিকেলে ইয়াছিনের সন্ধানে মাইক ভাড়া করে মাইকিং করান। শনিবার সকাল নয়টার দিকে স্থানীয় লোকজন লাশ দেখতে পেলে সিরাজুলও ঘটনাস্থলে যান। ওইসময় সিরাজুল গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে অভিযোগ করেন, আলামিনের শ্বশুর জাকির সরদার, তার ছেলে নাজমুল, রাসেল, কামাল এবং ইব্রাহিম হত্যার ঘটনার সাথে জড়িত। একই দাবি করেন, আলামিন ও তার মা আলেয়া বেগম। তবে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকেই থানায় নেওয়ার পর সেখানে হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করেন সিরাজুল ইসলাম।
ইয়াছিনের সৎ মা মনোয়ারা বেগম বলেন, বরিশালে আমার ছেলের বা আমাদের সাথে কারো কোনো শত্রুতা ছিলোনা। সে বরিশালে বেড়াতে এসেছিল। আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে এসে সে খুন হয়েছে। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই। নিহত ইয়াসিনের বাবা ছগির হোসেন বলেন, সিরাজুল আমাকে ফোন করে জানায় ইয়াছিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আমি বরিশাল এসে দেখি সন্তানের লাশ। আমরা খুনিদের বিচার চাই।
উল্লেখ্য, ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে নগরীর বসুন্ধরা হাউজিং এলাকার একটি পরিত্যক্ত টয়লেটের স্লাবের ওপর থেকে নয় বছর বয়সের শিশু ইয়াছিনের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।