দেশে ফের বৃদ্ধি পেয়েছে সয়াবিন তেলের দাম। খাদ্যপণ্যটি এতটা গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিদিন রসনা বিলাসে তেল ছাড়া চলা অসম্ভব। অথচ ধাপে ধাপে এর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অব্যাহত বৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কে বলতে পারে। এদিকে ভোক্তাদের নাভিশ^াস উঠছে। টিসিবি’র হিসেবে গত এক বছরে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ২৭ শতাংশ, ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ২৫ শতাংশ,এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিনে ২০ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও পামওয়েলের দাম ৩৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। সামনে রমজান মাস। ফলে তেলের চাহিদাও সারা বিশে^ই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত সরিষা,সূর্যমুখীসহ অন্যান্য তেলবীজ থেকে সোয়া দুই লাখ টন তেল পাওয়া যায়। বাকিটা আমদানি করতে হয়। বিশে^ সবচেয়ে বেশি সয়াবিন তেল আমদানি করে ভারত, তারপর আলজেরিয়া এবং বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ভেতর অন্যতম প্রধান উপকরণ হলো ভোজ্যতেল। ভোজ্যতেলের বাজার গত কয়েক মাস ধরেই ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সাথে চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। করোনার ধাক্কা সামলে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টারত মানুষের কাছে এটা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘাঁয়ের মতো। ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির পেছনে যদিও আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব রয়েছে তবে দফায় দফায় এই মূল্য বৃদ্ধি বাজারের সাথে জনজীবন অস্থির করে তুলছে। আমাদের দেশে পাম অয়েল মূলত মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। এই দাম বৃদ্ধির কোথায় শেষ তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ভোজ্য তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে নিন্ম ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এর প্রভাব বেশ জোরালোভাবেই পরছে।
আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা না থাকায় বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি। কারণ চাহিদার সাথে চাহিদা পূরণ এবং পূরণ করতে না পারার একটি যোগসূত্র রয়েছে যা প্রতিনিয়তই দেশের অসংখ্য নিন্ম ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো মুখোমুখি হচ্ছে। জনগণের জীবন মান নিয়ন্ত্রণের বড় নিয়ামক হলো সেদেশের বাজার ব্যবস্থা। বাজার যদি অস্থির হয় বা দ্রব্যমূল্য যদি ওঠানামা করে তাহলে জনগণের জীবনমানও ওঠা নামা করে। গড় আয় বৃদ্ধি পেলেও অস্থির বাজার কোনো দেশের অভ্যন্তরের জন্য স্বস্তির হতে পারে না। দেশের নিন্ম ও মধ্যবিত্ত মানুষের প্রধান টেনশনের কারণ থাকে বাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। আজ একটা পণ্যের দাম কমছে তো কালই আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনবেলা খাওয়ার পেছনেই যদি একটি পরিবারের অধিকাংশ অর্থ ব্যয় করতে হয় তখন বাকি মৌলিক চাহিদা পূরণ কঠিন হয়ে পরে। ইদানিং মাঝে মাধ্যেই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। যা দরিদ্র ক্রেতাদের জন্য অস্বস্তির কারণ।
এই করোনাকালীন সময়ে জীবন যাপন এমনিতেই নিন্ম ও মধ্যবিত্তদের জন্য কষ্টের তারপর বাজারের এই চিত্র তাদের নাকাল করে দিচ্ছে। অথচ সবার জন্য সুযোগ নিশ্চিত করতে হলে বাজার ব্যবস্থা দক্ষ হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে মানুষের জীবন যাত্রা পরিবর্তনের যে টানাপোড়েন শুরু হয় তার অন্যতম হলো আর্থিক সমস্যা। করোনায় বেকার বা অর্ধবেকার জীবন যাপন করতে শুরু কর বহু মানুষ। এখনো ঘুরে দাড়াতে আরও সময় লাগবে। জনগণের জীবনমান আরামদায়ক করতে সবচেয়ে আগে দরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ। সাধারণ মানুষ যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে ভোগান্তিতে না পরে সেটাই প্রধান দায়িত্ব। ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে। আমাদের দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদার ৯০ শতাংশই আমদানি করা হয় বাইরে থেকে। ফলে ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণের জন্য আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল।
অস্থির বাজারের সাথে অস্থির জনজীবন। ক্রমবৃদ্ধিপ্রাপ্ত বাজারের আগুনের আচ লাগছে সাধারণ মানুষের উপর। বলা যায় এই তাপে তারা রীতিমত জ্বলছে। কারণ এ জ্বালা কেবল যারা নিন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্ত শ্রেণির তাদেরই বেশি। এমনিতেই করোনাকালে খাঁড়া নেমেছে মধ্যবিত্তের ওপর। তারপর আবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিশেষ করে সবজির বাজার চড়া। নিন্ম আয়ের মানুষের স্বপ্ন এখন চাল,তেল কিনতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন তো এই দুটো পণ্য খাওয়া দাওয়ায় আমাদের লাগবেই। ভোজ্য তেল হিসেবে এখন যেমন আমরা সয়াবিন ব্যবহার করি, একসময় দেখেছি সরিষার তেল ব্যবহার করতো গ্রামাঞ্চলের বহু পরিবার। এখন তা বদলে সয়াবিন তেল হয়েছে। নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্ত হলো এমন এক শ্রেণির মানুষ যারা দুই শ্রেণির মাঝে থেকে সারা জীবন চ্যাপ্টা হয় কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। যে শ্রেণির মানুষের কাছে ফেব্রুয়ারি মাসটাই বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলে আর একত্রিশ দিনে মাস হলো একদিনের বোঝা। যারা লাইনে দাড়িয়ে আতœসম্মানের ভয়ে সাহায্য নিতে পারে না। এমনকি ঘরে একবেলা না খেয়ে থাকলেও কিছু বলতে পারে না। কারণ ওই আতœসম্মান। সংসার সামলানোর চিন্তায় তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সেই ভাঁজ কেউ দেখছে না। পাঁচ জনের একটি পরিবারে যদি একজন উপার্জন ক্ষম ব্যাক্তি থাকে তাহলে চাল,ডাল,সবজি কিনতেই প্রতিদিনের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে। এরপর আবার রয়েছে চিকিৎসা খরচ, পোশাক খরচ এবং এরকম হাজারটা খরচ। একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হলো, কারও আয় যতটুকুই বৃদ্ধি পাক তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখা। কোনোভাবেই যেন তা হাতের নাগালের বাইরে না যায়। বাঙালি ভাত প্রিয় মানুষ।
মূল্য বৃদ্ধির খবরে মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিন্মবিত্ত,মধ্যবিত্ত মানুষগুলো কোথায় দাড়াবে? বাজার করতে গিয়েই তার দৈনিক আয়ের বেশিরভাগ অংশই খরচ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে পরিবারের অন্য আবদার সে কিভাবে পূরণ করবে? তারও তো সন্তান আছে। তাদের ইচ্ছে হয় বাবার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার। তারা বাজার বোঝে না। বাবা যদি বলে বাজারে জিনিসপত্রের খুব দাম তাতে তারা খানিকটা অবাকই হয় বটে। নিত্যদিন যখন সকালে উঠে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বিরস মুখে বাজারের দিকে রওনা হয় তখন জিনিসপত্রের দাম তাকে অস্থির করে তোলে। মানুষের জীবনযাপন তখনি সুন্দর হবে যখন ভোজ্যতেল,চাল,মাছ,মাংসসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে। ক্রয়ক্ষমতা থাকা কথাটির অর্থ হলো আমার পরিবারের জন্য যেটুকু দরকার তা কেনার সামর্থ্য বোঝানো। ভোজ্য তেলের লাগামহীন বৃদ্ধিতে ক্রেতাদের অস্বস্তি¡ বাড়ছে। যেকোনো ভাবেই হোক ভোজ্য তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
অলোক আচার্য
মুক্তগদ্য লেখক, পাবনা