২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১ম সপ্তাহে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধায় হঠাৎ জ্বরে আক্রন্ত হওয়ার তিন-চার দিনের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকে শত শত মানুষ। ওই সময় একাধিক বাবা-মা হারিয়েছেন তাদের অবুঝ সন্তানকে। হাতের মেহেদির রঙ শুকানোর আগেই হতভাগিনী হারিয়েছেন তার স্বামী।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয়েছিল অবুঝ শিশুসহ সদ্য বিবাহিত যুবক ও নারীরা। একে একে চিরবিদায় নিয়ে পৃথীবি থেকে চলে যান ২৪ জন। অনেকেই বলেন চির বিদায় নেয়ার সংখ্যা ২৪ এর চেয়ে বেশী হবে কারণ, সঠিক হিসাব কেউ রাখেনি সে সময়। কারন, হঠাৎ শুরু হয়েছিল এক অচেনা/অজানা রোগের আক্রমণ। যে রোগের উপসর্গ ছিল শুধু ‘জ্বর'। হতাশ হয়ে এলাকার মানুষ অন্য এলাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১ম সপ্তাহে হঠাৎ করে দেখা যায় অজানা ‘জ্বর'। জ্বরে সংক্রামিত হওয়ার তিন-চার দিনের মধ্যে আক্রান্তরা ঢলে যেতে থাকেন মৃত্যুর কোলে। হাতীবান্ধা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছিল না এ অজানা রোগে তেমন কোন চিকিৎসা। পরে ঢাকা থেকে (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞরা এসে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে জানান এটি আসলে এনকেফালাইটিস। যা নিপাহ ভাইরাস হিসেবে পরিচিত।
ভাইরাসটি বাঁদুড় থেকে ছড়িয়েছে। খেজুড়ের রস থেকে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। যদিও সরকারিভাবে এ মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ জন বলে দাবি করা হয়। তবে এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শিশু, নারীসহ বিভিন্ন বয়সী ২৪ জনেরও বেশি প্রাণ হারান।
হাতীবান্ধা বাস¯ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা শিক্ষক অশোক ঘোষ-তাপসী ঘোষ দম্পতি ২০১১ সালের এই সময়ে নিপা ভাইরাসের কারণে হারিয়েছিলেন তাদের দুই সন্তানকে। অপরদিকে, দক্ষিণ গড্ডিমারী গ্রামের জাহাঙ্গীর তিনিও হারিয়েছিলেন তার ছোট্ট দুই মেয়ে জয়ী ও সর্বাকে। বিয়ের ১১ মাস পর নিপাহ ভাইরাসের আক্রমণে অন্তসত্তা স্ত্রীকে ছেড়ে চির বিদায় নেন আজিজুল (২৭)। হাতের মেহেদির রঙ শুকানোর আগেই হতভাগিনী লিপি বেগম স্বামীকে হারিয়ে এখনও শোকাহত।
কিছুদিন পর লিপির কোলে ফুটফুটে এক শিশুর জন্ম হয় ঠিকই কিন্তু বাবা নামক সেই প্রিয় ডাক অধরাই থেকে সেই শিশুটির। ভাইরাস আক্রমণ বৃদ্ধির কারণে কয়েকদিনের মধ্যে এলাকায় হতাশা ও নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় নিজ নিজ বাড়ি ছাড়তে শুরু করেন অনেকে। শুরু হয় ঘোষণাবিহীন জনশুন্য উপজেলা হাতীবান্ধা। হাট-বাজার, শহর-বন্দরের প্রায় সকল দোকান বন্ধ হয়ে যায়। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাহিরে কেউ বের হয়না।
দীর্ঘ ১১ বছর পরে ২০১১ সালের সেই ফেব্রুয়ারি মাস আবারও ফিরে এলেও ওইসব প্রাণহানীর কথা মনে করে দেয় এলাকাবাসীর। তাই আপনজনদের হারানোর ব্যথায় আজও ব্যথিত স্বজনেরা।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাতীবান্ধায় আসা রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞ দল জানিয়েছিলেন, যেহেতু নিপা ভাইরাসের বাহক বাঁদুড় তাই কোনো এলাকায় একবার এ রোগ দেখা দিলে পরবর্তী কয়েকটি বছর শীতের মৌসুমে রোগটি পুনরায় ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। তাই স্বাস্থ্য সচেতনতাই এই ঘাতক নিপা ভাইরাস থেকে রক্ষার একমাত্র পথ বলে জানান বিশেষজ্ঞ দলটি।
সেই থেকে পরবর্তী বছরগুলোতেও বেশ প্রচার-প্রচারণা হওয়ায় জনসাধারণ মোটামুটি সর্তক হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এ বছর স্বাস্থ্য সচেতনতায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো লক্ষ করা যায়নি।
এ বিষয়ে হাতীবান্ধা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: নাঈম হাসান নয়ন জানান, ফেব্রুয়ারী মাস এলেই সেই ২০১১ সালের কথা মনে পড়ে যায়। যদিও এখানকার মানুষ এখন অনেকটাই সচেতন। যে কারণে সেই নিপা ভাইরাসের প্রকোপ আর দেখা যায়নি। এই ভাইরাস থেকে বাচাঁর একমাত্র উপায় সচেতনতা থাকা।