সব সম্পর্কই গুরুত্বপূর্ণ- কিন্তু মা-বাবার সমকক্ষ নয়। সব পেশাই সম্মানিত- কিন্তু শিক্ষকের সমতুল্য নয়। আর্থিক মূল্যে সব কিছু মাপা যায় না। একজন শিক্ষকের সম্মান মর্যাদা যে সমাজে আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করা হয়, সে সমাজ কতটা দেউলিয়া তা সহজেই অনুমান করা যায়। শিক্ষক শব্দই এ জাঁতি বুঝতে অপারগ। এই শব্দ ধারণের ক্ষমতা শিক্ষকদের নিজেদেরও মনে হয়নি। নয়তো যে পেশাটি হওয়া উচিত সবচেয়ে মর্যাদা আর সম্মানের, সে পেশাটা হলো অবহেলা আর অবজ্ঞার।
স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের প্রাপ্তি অনেক। তলাবিহীন ঝুঁড়ি থেকে এখন আমরা মধ্যম আয়ের দেশ। আমদানি বাদ দিয়ে এখন আমরা রপ্তানি করি। উন্নয়নের ছোঁয়া জীবনের সর্বক্ষেত্রে। আমাদের জীবন যাত্রার মান বেড়েছে। বেড়েছে আয়। অথচ শিক্ষকের জীবনমানের কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং শিক্ষক শব্দটি হারিয়েছে তার নৈতিকতা এবং উপযোগিতা।
নীতি বোধের বাণী শ্রবণে জীবন চলে না। একটি উন্নত জীবনমান ব্যতীত কেন এই পেশায় আসবে মেধাবী আর সৃজনশীলরা? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এখন এসেছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১৩তম গ্রেডে। তাও অনেক আন্দোলন, অপমান, পুলিশের বুটের আঘাতের পর। শিক্ষকদের দৈনিক টিফিনভাতা সাড়ে ছয় টাকা। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের যুগে শিক্ষকদের জন্য এই অসম্মানের টিফিনভাতা আমাদের গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনক হওয়ার কথা ছিল। না, তা হয়নি। বরং পদের উচ্চ স্তরে থাকা জনৈক কর্মকর্তা দম্ভের সঙ্গে বলেছেন, শিক্ষকরা তো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখেই এই পেশায় এসেছে।
একটু একটু করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি অনেকটা পথ। পরিবর্তন এসেছে অনেকের পেশায়, জীবনে। যেমন: ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ছিল ১৪তম গ্রেড। বর্তমানে ১০ম গ্রেড। কৃষি উপপরিদর্শক এসএসসি শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং ডিপেস্নামা করে ১০তম গ্রেড। ভূমি অফিসের তহশিলদার ১৭তম গ্রেড থেকে বর্তমানে ১০তম গ্রেডে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা ১৬তম গ্রেড থেকে ৯ম গ্রেডে। নার্সেরা ডিপেস্নামা করে এখন ১০তম গ্রেডে।
যে শিক্ষাগত যোগ্যতায় প্রাথমিকের শিক্ষকের বেতন ১৩তম গ্রেডে তার চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতায় অন্য পেশাজীবীদের বেতন ১০তম গ্রেডে।
'২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়নে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।' (ভিশন-২০২১' ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা-২০০৯, পৃষ্ঠাঃ ৫১)
কথা রাখেনি তারা।
মা-বাবার অধিকারের জন্য চিৎকার আর পাড়া প্রতিবেশীদের অধিকারের জন্য চিৎকার এক নয়। শিক্ষক তার বঞ্চনা আর দরিদ্রতাকে মেনে নিয়ে এতকাল দয়া করেছে এ অকৃতজ্ঞ জাতিকে।
পাদটীকা গল্পের লেখক পন্ডিতমশাইয়ের গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে না পেরে লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। কিন্তু বর্তমান যুগে অকৃতজ্ঞরা লজ্জিত না হয়ে বরং ঔদ্ধত্তের সঙ্গে, দম্ভের সঙ্গে অপমান করে শিক্ষকদের।
ইতিহাস বলে, অনেক অত্যাচারী শাসকও অবনত শিরে শ্রদ্ধায় দাঁড়িয়েছে শিক্ষা গুরুর সম্মুখে। কিন্তু নিজেদের যখন সভ্য বলে, শিক্ষিত বলে দাবি করছি তখন অসম্মানের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পাচ্ছে কিছু অসৎ, দাম্ভিকের আচরণে।
অনেক দিন তো হলো। অসৎ লোকের সততার বাণী শ্রবণে, নীতিবাক্য ধারণ করে কেটে গেছে সময়। পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে।
শিক্ষকের শিক্ষার্থীরা মন্ত্রী হয়, সচিব হয়। ভাগ্য পাল্টায় না শিক্ষকদের। যে প্রয়োজনটা উচ্চ পর্যায়ে থাকা শিষ্যদের অনুধাবন করা উচিত ছিল, সে প্রয়োজনটা নিয়ে আজ শিক্ষকরা যখন কথা বলছেন তখন গোটা জাতির লজ্জিত হওয়া উচিত।
পঞ্চাশ বছরেও কেন শিক্ষকের জীবনমানে পরিবর্তন এলো না? কেন অন্যরা দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হলো অথচ শিক্ষক রয়ে গেল তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী? কেন মেধাবীরা এই পেশায় আসে না? কেন মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানো শিক্ষককে রাষ্ট্র ভয় পায়? কেন প্রকৃত শিক্ষক তৈরিতে রাষ্ট্র কখনোই আগ্রহী হয় না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই উপাচার্যদের অযোগ্যতা কেমন করে ধ্বংস করে দিচ্ছে উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ।
প্রাথমিক স্তর শিক্ষার ভিত। এই স্তর নড়বড়ে হলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।
বিদেশ থেকে আমদানি করা শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-ভাতা এবং জীবনমানের দিকেও লক্ষ্য রেখে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। পাশের দেশ ভারতের সঙ্গেই আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনের পার্থক্য আকাশ পাতাল।
যে দেশ নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারে, সে দেশ তার দেশের শিক্ষা গুরুকে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী করে রাখতে পারে না। ১০ম গ্রেডে বেতন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের অধিকার। এই সত্যটা বুঝবার জন্য শিক্ষক শব্দটা বুঝতে হবে। শিক্ষক শব্দের সম্মান এবং মর্যাদা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া : কবি, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলাম লেখক