খুলনার ভৈরব সেতুর নির্মাণকাজের চুক্তি অনুযায়ী মেয়াদ ছিল ২৪ মাস। ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও নির্মাণ কাজে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বললেই চলে।ভৈরব সেতুর নির্মাণ কাজের সাড়ে ১৪ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও কাজের অগ্রগতি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। সাড়ে ১৪ মাসে কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের বক্তব্য দ্রুতগতিতে সেতু নির্মাণের সকল প্রস্তুতি থাকা সত্বেও শুধুমাত্র ভূমি অধিগ্রহণ ও বৈদ্যুতিক খুঁটি অপসারণে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ভৈরব সেতু নির্মাণ কাজে গতি আসছে না।
ভূমি অধিগ্রহণের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে খুলনা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) মোঃ মারুফুল ইসলাম এর সাথে কথা হয়। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, গত বছরের ২০ ডিসেম্বরে জেলা প্রশাসন এবং খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এর সার্ভেয়িং টিম নিয়ে সেতুর দিঘলিয়া অংশ আমরা সরেজমিনে পরিদর্শন করি। অতঃপর জেলা প্রশাসনের ভূমি বরাদ্দ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গত সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি) জেলা প্রশাসক ভূমি বরাদ্দ কমিটির রেজুলেশনে স্বাক্ষর করে এটি অনুমোদন দিয়েছেন। দ্রুতই আমরা ভূমির মালিকদের ৪ এর (১) ধারা মোতাবেক নোটিশ প্রদান করব।তিনি আরও বলেন, প্রথম নোটিশ প্রদানের ১৫ দিন পর বিধি অনুযায়ী আমরা দ্বিতীয় নোটিশ প্রদান করব। এভাবে ধাপে ধাপে আমরা আমাদের কার্যক্রম দ্রুততার সাথে চালিয়ে যাবো। আর সেতুর পশ্চিম পার্শ্বের অংশ যেহেতু সিটি কর্পোরেশনের আওতাভূক্ত এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের সম্পত্তি জেলা প্রশাসক এ ভূমির অনুমোদন দিলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পাস হয়ে আসতে হবে। সেটিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
দিঘলিয়া উপজেলার বিজ্ঞমহলের অভিমত বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বড় বড় সেতু নির্মাণ হয়েছে বা হচ্ছে। কোনো সেতুর ব্যাপারে ভৈরব সেতুর ন্যায় টানা পড়েন পরিলক্ষিত হয়নি বা হচ্ছেনা। খুলনার ভৈরব সেতুর ব্যাপারে কেন এত বাঁধা? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ডক্টর মশিউর রহমান ও খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মূর্শেদী, খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আনিসুজ্জামান মাসুদ খুলনার মানুষের এই দীর্ঘদিনের স্বপ্নের ভৈরব সেতু নির্মাণ কাজের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে গতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা ও প্রতিশ্রুতি দিয়েও কোনো এক অদৃশ্য কারণে ভৈরব সেতুর নির্মাণ কাজে গতি আসছে না। ভৈরব সেতু নির্মাণে এত জটিলতা কেন? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সেটিই আগে ক্ষতিয়ে দেখা জরুরী। মহলটি আরো বলেন, সেতুর নির্মাণ কাজ শুরুর প্রাক্কালেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলেছিলেন সেতুর কাজও চলবে, ভূমি অধিগ্রহণ ও অন্যান্য সমস্যা সমাধানের কাজও চলবে। কিন্তু তার সত্যতা কোথায় থাকছে?
এদিকে ভূমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার কারণে কার্যাদেশ পাওয়ার সাড়ে ১৪ মাস পরও সেতুর নির্মাণ কাজ পুরোদমে শুরু করতে না পারায় সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লিঃ (করিম গ্রুপ) আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ইতোমধ্যে সেতু নির্মাণ কাজে ১ শ’ কোটি টাকার বিনিয়োগ করলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কাজের বিপরীতে কোন বিল তুলতে তুলতে পারেনি। ক্রমান্বয়ে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৫৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বসিয়ে বসিয়ে প্রতিমাসে ১৫ লক্ষ টাকার বেতন দিতে হচ্ছে। বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, ইন্টারনেট বিলসহ অন্যান্য বিল বাবদ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। সেতু নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য অনেক ইকুপমেন্ট ভাড়া করে আনা হয়েছে। প্রতিমাসে সেগুলোর জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই গতবছরের ২৪ মে সেতুর পূর্ব সাইড দিঘলিয়া উপজেলার দেয়াড়া ইউনাইটেড ক্লাব সংলগ্ন ঈদগাহের মধ্যে সেতুর ২৫ নং পিলারের টেস্ট পাইলিং এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ভৈরব সেতুর নির্মাণ কাজ। খুলনাবাসীর বহু প্রত্যাশিত এবং আকাক্সিক্ষত ভৈরব সেতুর নির্মাণ কাজের সর্বশেষ অগ্রগতি বলতে সেতুর দিঘলিয়া অংশে ২৪ এবং ২৫ নং পিলার এর ১০ টি করে ২০ টেস্ট পাইলিং এবং টেস্ট পাইল পরবর্তী লোড টেস্ট এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর সেতুর পশ্চিম পাশে ভৈরব নদীর তীরে ১৩ নং পিলার এর ১০ টি টেস্ট পাইলিং সম্পন্ন হয়েছে এবং লোড টেস্ট এর কাজ চলমান রয়েছে। একই স্থানে নদীর তীরবর্তী ১৪ নং পিলার এর শীট পাইলিং ড্রাইভের কাজ সম্পন্ন হয়ে কেজিং এর জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভৈরব সেতু নামে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। এরপর ২০২০ সালের ২৭ জুলাই খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ সওজ এর খুলনা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ভৈরব নদীর উপর সেতু নির্মাণ কাজের দরপত্র আহবান করেন। প্রক্রিয়া শেষে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লিঃ (করিম গ্রুপ) নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ভৈরব সেতুর নির্মাণকাজ দেওয়ার বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর ১৩ দিন পর ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কার্যাদেশ পাওয়ার পর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সেতুর দিঘলিয়া অংশে দেয়াড়া ইউনাইটেড ক্লাব মাঠে অফিস বেস ক্যাম্প প্লাস স্টক ইয়ার্ড তৈরি করে সেতুর ইকুপমেন্ট স্টক করতে শুরু করে
ভৈরব সেতুর জন্য দিঘলিয়া, মহেশ্বরপাশা এবং দেবনগর মৌজার মোট ১৭ দশমিক ৪৯ একর (৭ দশমিক ০৮ হেক্টর) ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন।
এরমধ্যে সেতুর খুলনা শহরাংশ অর্থাৎ নগরীর কুলি বাগান থেকে রেলিগেট পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭ দশমিক ১১৩৬ একর (২ দশমিক ৮৮ হেক্টর) ভূমি রয়েছে। সেতুর উভয় পাশের ওই জমি অধিগ্রহণের জন্য খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এর কার্যালয় থেকে গত বছরের নভেম্বর মাসে ভূমি অধিগ্রহণের এর কাজ দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করার জন্য ২টি সংশোধিত প্রস্তাবনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রেরণ করে।
সওজ সূত্রে জানা যায়, ভৈরব সেতুর পিলার বসবে মোট ৩০ টি। এরমধ্যে নদীর পশ্চিমপাশ অর্থাৎ নগরীর কুলিবাগান থেকে রেলিগেট ফেরিঘাট সংলগ্ন নদীর তীর পর্যন্ত ১ থেকে ১৪ নং পিলার বসবে। এই অংশের প্রথম পিলারটি বসবে নগরীর কুলিবাগান আকাক্সক্ষা পাট গোডাউনের কর্ণারে। ৫ এবং ৬ নং পিলারের মাঝখান দিয়ে রেললাইন ক্রস করবে। এরপর ৭ এবং ৮ নং পিলার বসবে। ৯ থেকে ১৩ নং এই ৫ টি পিলার বসবে নগরীর রেলিগেট ঢাকা ট্রেডিং হাউজ লিঃ এর অভ্যন্তরে। এর ফলে রপ্তানিকারক এ প্রতিষ্ঠানটি ভাঙ্গা পড়বে। ১৭ থেকে ২৮ নং পিলার বসবে ভৈরব নদীর পূর্বপাশ অর্থাৎ দিঘলিয়া উপজেলার নগরঘাট বানিয়াঘাট ফেরী সংলগ্ন মধ্যবর্তী স্থান থেকে উপজেলা সদরের কুকুরমারা পর্যন্ত।
পশ্চিম পাশে নদীর পাড় থেকে ৪২ মিটার ভেতরে ১৫ নং পিলার এবং পূর্ব পাশে নদীর পাড় থেকে ১৮ মিটার ভেতরে ১৬ নং পিলার বসবে। এ ছাড়া সেতুর উভয় দিকে সেখান থেকে সেতুর স্লোপ শুরু হবে সেখানে এ-১ এবং এ-২ দুটি এবাটমেন্ট বসবে। নদীর ভেতর কোন পিলার বসবেনা। ১৫ এবং ১৬ নং পিলারের উপর ১০০ মিটার স্টিলের সীটে বসবে নদীর উপর মূল সেতুটি। নেভিগেশনের জন্য যাতে সেতুর নিচ দিয়ে অনায়াসে কার্গো এবং জাহাজ চলাচল করতে পারে সে জন্য মূল ব্রীজের স্লাব বটম জোয়ারের পানি থেকে ৬০ ফুট উঁচু হবে। ১৭ ডিসেম্বর ‘ভৈরব সেতু’ নামে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। ভৈরব সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৩১৬ কিলোমিটার। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১৭ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ২ বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বরের মধ্যে সেতু নির্মাণের কাজ শেষ করার কথা।