মাত্র ৯ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়ার ২০ বছর পর মা-বাবা ও স্বজনদের কাছে ফিরেছেন রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের মেয়ে বেবী আক্তার। পরিণত বয়সে নতুন পরিচয়ে বিয়ে-সংসার-সন্তানও হয়। বাবা-মা পরিবার হারানোর কষ্ট বুকে চেপে দিন পার করছিলেন মধ্যবয়সী এই নারী বেবী আক্তার।
২০০২ সালে আর্থিক অচ্ছলতার জন্য ঢাকার মিরপুরের এক বাসায় পরিবারের সেবা করার জন্য মেয়ে বেবীকে দেয় তার বাবা মা। বেবী ওই পরিবারে দশ মাস থাকলেও নির্যাতনের কারণে সে পালিয়ে যায়। পরে বেবী মিরপুরের একটি রাস্তার পাশে কান্না করতে ছিল। তখন বেবীকে কান্না করতে দেখে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জসিম সরদারের মা শাহানুর বেগম তাকে নিয়ে বাড়ি চলে আসে। তখন বেবী তার নাম ও উপজেলার নাম বলতে পারলেও বাবা মায়ের ঠিকানা বলতে পারেনি।
অনেক চেষ্টা করেও সেসময় তার খোঁজ পায়নি বেবীর পরিবার। দীর্ঘদিন পর মেয়েকে ফিরে পেয়ে পরিবারটির মধ্যে এখন খুশির জোয়ার বইছে।
বুধবার সন্ধ্যায় সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জসিম সরদারের বাড়িতে বেবীর বাবা রফিজ মন্ডল ও মা সুফিয়া বেগম দম্পতির মেয়ে বেবী তার নিজ গ্রামে ফিরেন।
বেবীর বাবা রফিজ মন্ডল জানান, আমরা গরীব পরিবারের লোক। দিন আনি দিন খাই। তিন মেয়ে এক ছেলে নিয়ে আমাদের পাঁচ জনের পরিবার। আর্থিক অচ্ছলতার জন্য আমার বড় মেয়ে বেবী আক্তারকে আমাদের দুর্গাপুর গ্রামের কামাল হোসেন সোহেল এর ঢাকার মিরপুরে বাসায় তাদের দেখাশুনা করার জন্য দেই। তখন আমার মেয়েকে কামাল হোসেন সোহেলের পরিবার নির্যাতন করতো। কিন্তু আমার মেয়ের সাথে কোন যোগাযোগ করতে দিত না তারা। পরে আমার মেয়ে বেবী তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তাদের বাসা থেকে পালিয়ে যায়। আমার এক আত্মীয়র মাধ্যমে তখন জানতে পারি বেবীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আমরা মেয়ে বেবী হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় দুর্গাপুর থানায় কামাল হোসেন সোহেলের নামে অভিযোগ দায়ের করি। তখন পুলিশ ও আমরা একাধিক স্থানে আমার মেয়ে বেবীকে খুঁজেও তার সন্ধান পাইনি।
মেয়েকে ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত মা সুফিয়া বেগম জানান, ২০ বছর ধরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মেয়েকে পাওয়া যায়নি। ২০ বছর পর মেয়েকে ফিরে পাবেন, আশা ছিল না। তিনি আরও জানান, ২০ বছর পর মেয়েকে খুঁজে পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত।
সূত্র জানায়, বর্তমানে এক ছেলে এক মেয়ে ও স্বামী নিয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলার নগরবাড়ি গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে বেবীর সংসার। হারিয়ে যাবার পর আগৈলঝাড়া উপজেলার কালুপাড়া গ্রামের মৃত ওয়াজেদ আলী সরদার ও শাহানুর বেগমের বাড়িতে নিজের মেয়ের মত বড় হয়েছেন বেবী। ২০১৪ সালে বেবীকে বিয়ে দিয়েছেন তারা।
আগৈলঝাড়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জসিম সরদার বলেন, আমার মা শাহানুর বেগম ঢাকার এক আত্মীয়র বাসায় বিয়ে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তখন রাস্তার পাশে কান্না করতে দেখে আমার মা বেবীর কাছে এগিয়ে গেলে তাকে জড়িয়ে ধরে বেবী তাকে তার সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। তখন আমার মা বেবীর কাছে ঠিকানা জানতে চাইলে সে শুধু তার নাম এবং এলাকার কথা বলতে পারলেও আর কিছু বলতে পারেনি। তখন আমার মা বেবীকে আমাদের গ্রামের বাড়ি আগৈলঝাড়ার কালুপাড়া গ্রামে নিয়ে আসে। সেই থেকে বেবী আমাদের পরিবারের সন্তান হিসেবে বড় হয়। এমনকি বেবীর জাতীয় পরিচয়পত্রেও আমার বাবা মার নাম দেয়া হয়। আমরা আপন ৪ ভাই, ২ বোন এবং পরে বেবী আমাদের ছোট বোন হিসেবে ৩ বোনের মর্যাদা পায়। আমার বড় দুই বোনকে বিয়ে দেয়ার সময় কোন অনুষ্ঠান করতে না পারলেও ছোট বোন বেবীকে অনেক বড় অনুষ্ঠান করে উপজেলার নগরবাড়ি গ্রামের ব্যবসায়ী সোহেল ফকিরের সাথে বিয়ে দেই। সোহেল ও বেবীর সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
এ বিষয়ে বেবী আক্তার বলেন, কোনো দিন ভাবতেও পারিনি, বাবা-মাকে আবার ফিরে পাবো। আমার একটাই চাওয়া ছিল জীবনে মা-বাবাকে যেন একবার হলেও দেখতে পারি।
বেবী আক্তার আরও জানান, আমার বাসার ছেলে মেয়ের গৃহ শিক্ষক নগরবাড়ি গ্রামের শাহাদাৎ খলিফার স্ত্রী পারভীন বেগম তার কলেজ জীবনের এক সহপাঠি রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর গ্রামের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলামকে আমার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা খুলে বললে আমিনুল দুর্গাপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান লতিফ হোসেনের ভাই শহিদুল ইসলামের মাধ্যমে তার বাবা মাকে খুঁজে বের করে।
পরে বেবীর সাথে তার বাবা মায়ের ফোনে কথা হলে তারা নিশ্চিত হয় হারিয়ে যাওয়া বেবীই তাদের মেয়ে।