ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও যশোরসহ বিভিন্ন জেলায় এখনও পৌঁছেনি ২০২২ শিক্ষাবর্ষের সব পাঠ্যপুস্তক। বারবার চেয়েও প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক পাচ্ছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। পাঠ্যবই সরবরাহ না হওয়ায় বিকল্প হিসেবে নোট-গাইড বা সহায়ক বই কিনতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অনেক ক্ষেত্রে স্কুলের শ্রেণিশিক্ষকরাও নোট-গাইড বা সহায়ক বই কিনতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মূলত নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায় জড়িত এমন কয়েকটি ছাপাখানার (প্রিন্টিং প্রেস) মালিক পাঠ্যবই ছাপার কার্যাদেশ নিয়ে বই সরবরাহ করেনি। এখন এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করা হতে পারে। শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন। বিনামূল্যের পাঠ্যবই পৌঁছেনি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেবেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন আরও জানান, খিলগাঁওসহ মহানগরীর বেশির ভাগ স্কুল এখন পর্যন্ত সব ক্লাসের সব বিষয়ের পাঠ্যবই পায়নি। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগেই একসঙ্গে সববই পাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু এবার ‘ভেঙে ভেঙে’ বই দেয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বারবার স্কুলে এসেও বই পাচ্ছে না বলে জানান তিনি। তেজগাঁও নাজনীন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তার স্কুলেও দু’তিনটি বিষয়ের পাঠ্যবই এখনও পৌঁছেনি। তবে স্কুল বন্ধ থাকায় ওইসব বইয়ের জন্য কোন সমস্যা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
এনসিটিবির দুইজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জাহানারা প্রেস, প্রেস লাইনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েও বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপায়নি। এর মধ্যে ‘প্রেস লাইন’ নামের প্রতিষ্ঠানটি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর দুটি লটের বই ছাপার কাজ নিয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের বই নারায়ণগঞ্জে পাঠানোর কথা ছিল। বই না ছাপানোর কারণে ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে ওই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (টেক্সট) অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম গতকাল বলেন, দু’একটি প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ নিয়ে বই দেয়নি। তবে ওইসব বইয়ের চাহিদা বাফার স্টক (আপদকালীন মজুত) থেকে পূরণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন ওইসব বই স্কুল থেকে সংগ্রহ করতে পারবে।’
২০১০ সাল থেকে সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করে আসছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ প্রতি বছর সরকারের এই কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করছে। নতুন বছরের প্রথমদিনই সারা দেশে উৎসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থী হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়। পাঠ্যপুস্তক উৎসব চলে সপ্তাহব্যাপী। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে এ উৎসবের আয়োজন স্থগিত রাখা হলেও ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহেও সব শিক্ষার্থী পাঠ্যবই হাতে পায়নি।
এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ শিক্ষাবর্ষের জন্য মোট ৩৫ কোটির কিছু বেশি বই ছাপার কথা। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের জন্য ছাপা হচ্ছে ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৯২ হাজার ২৮৮টি বই। এর মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দুই লাখ ৩৬৪টি বই রয়েছে। বাকি বই মাধ্যমিক স্তরের।
প্রতিবছরই ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য স্থির করা হয়। তবে এবার বিপত্তি ঘটেছে, কারণ ২০২২ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার কাজে গত বছর জোটবদ্ধভাবে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী বেশি দামে (প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২০-৩০ শতাংশ বেশি) দরপত্র জমা দেয়। ব্যবসায়ীদের এই তৎপরতা ঠেকাতে পুনঃদরপত্র আহ্বান করে এনসিটিবি। এতে সরকারের প্রায় ২৩০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে, তবে ছাপার কাজ পিছিয়ে গেছে। এই সুযোগে ‘নোট-গাইড’ বা সহায়ক বইয়ের ব্যবসায়ীদের তৎপরতা বেড়েছে।প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ঢাকার দুটি থানার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কয়েকটি বিষয়ের বই সরবরাহে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। এই সুযোগে ‘নিষিদ্ধ’ নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীদের তৎপরতা বেড়েছে। তারা ‘চড়া মূল্যে’ এসব বই কিনতে নানাভাবে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের উদ্ভুদ্ধ করছেন। অনেক অভিভাবক এ বিষয়ে অভিযোগও দিচ্ছেন। ‘মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসন’ এ বিষয়ে খোঁজ রাখছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলায় পঞ্চম শ্রেণীর একটি বইও সরবরাহ হয়নি। এই উপজেলায় চতুর্থ শ্রেণীর অর্ধেক বই সরবরাহ হয়েছে। এই জেলার বন্দর উপজেলায় এখনও পঞ্চম শ্রেণীর কিছু বই পৌঁছেনি। সদর উপজেলার কে এ একাডেমির প্রধানশিক্ষক কাউসার আহমেদ গতকাল বলেন, তার স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীর কোন বই দেয়া হয়নি। আর চতুর্থ শ্রেণীর ছয়টি বইয়ের মধ্যে তিনটি বই তারা পেয়েছেন, বাকি তিনটি বিষয়ের কোন বই তাদের সরবরাহ করা হয়নি বলে জানান তিনি।
নারায়ণগঞ্জের একজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা বারবার জেলা শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করেও চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক পাচ্ছেন না।
রাজধানীর খিলগাঁও থানার পূর্ব গোড়ান আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল হোসেন গতকাল বলেন, ‘আমার স্কুলে প্রায় এক হাজারের মতো ছাত্রছাত্রী রয়েছে। আমরা সাতবার গিয়েও মতিঝিল থানা শিক্ষা অফিস থেকে সব বই পাচ্ছি না। শিক্ষার্থীদের কাউকে দুটি বা তিনটি; কাউকে অর্ধেক বই দেয়া সম্ভব হয়েছে।’
এদিকে খুলনা মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন থানার বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বিদ্যালয়গুলোর চাহিদার শতভাগ পাঠ্যবই পাইনি। খুলনা বিভাগীয় শিক্ষা অধিদপ্তরের এক সূত্র থেকে জানা যায় খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার বিদ্যালয়গুলোতে চাহিদা অনুযায়ী শতভাগ পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বিদ্যালয়গুলোর চাহিদার শতভাগ বই এখনও পৌঁছেনি।