বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে হাঁটতে গিয়ে দেখা অসংখ্য বিষয়ের মধ্যে একটি চরমরকম ভাবনার বিষয় হলো- পুরো রাজধানীর কোন ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কোনো পরিস্থিতি নেই। সবগুলো ফুটপাতে অতিরিক্ত দোকান, তার মধ্যে মানুষের হেঁটে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এত ভিড় থাকে যেখানে পুরুষ মানুষই হাঁটতে পারে না আর আমরা মেয়ে মানুষ কীভাবে হাঁটব? অনেকেই ফুটপাতে হাঁটতে না পেরে আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাধ্য হয়েই মূল সড়ক দিয়ে চলাচল করছে। আর এভাবে সড়ক দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে অনেক সময় পথচারীরা দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে গিয়ে কাউকে আবার হতে হয়েছে হকারদের হাতে লাঞ্ছিত।’
আপনারা যারা এই লেখাটির পাঠক, তাদেরকে করছি প্রশ্নটি- ‘ফুটপাত দিয়ে কি হাটতে পারেন নিশ্চিন্ত মনে, নাকি কষ্টে থাকেন হাঁটতে গিয়ে? উত্তরে আপনি যদি ‘না’ বলেন, তাহলে সাথে সাথে মন থেকে বেরিয়ে আসবে ভয়ংকর ভাবে বদদোয়। কারণ- ফুটপাত দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য আর আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার রাস্তা হিসেবে ‘লাইনম্যান’ নামক কষ্টমানুষ সৃষ্টির রামরাজত্ব রয়েছে। সেই রাম রাজত্ব তৈরির জন্য কখনো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ব্যবহৃত হচ্ছে, নয়তো ব্যবহৃত হচ্ছে জাতির পিতা এবং তাঁর কন্যার ছবি। ফুটপাত দখল করে বাণিজ্যময় বর্তমানে নেপথ্য কারিগর হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী যুব-ছাত্র- স্বেচ্ছাসেবি-শ্রমিক লীগ যেমন রয়েছে, রয়েছে সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অধিকাংশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত। তাহলে উপায়? উপায় পাবে না বাংলাদেশ ‘ফুটপাত দখলমুক্ত’ করার?
উপায় পাক না বা না পাক। বাস্তবতা হলো এই- মিরপুর মাজার রোডের লালকুঠি এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার ফুটপাতই দখল করে লাইনম্যান দিয়ে চাঁদা ওঠাচ্ছে ছাত্র-যুবসগ বিভিন্ন সরকার দলীয় অঙ্গ সংগঠন। ফুটপাত দখলের কারণে নির্মম ভোগান্তিতে আছে ছাত্র-যুব-জনতা। তার প্রমাণ দেখতে চলুন একটি ঘটনায় চোখ রাখি- রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার তেজগাঁও কলেজের সামনের মূল সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। পেছনেই সিএনজি অটোরিকশা চালক হর্ন বাজিয়ে বলছিলেন, ‘ভাই একটু সাইড দিয়ে হেঁটে যান’। চালকের কথা শুনে শিক্ষার্থী বলেছেন ‘কোথায় যাব? ফুটপাতে দোকান, রাস্তায় গাড়ি, বিপাকে আমাদের মতো পথচারী’। এভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজধানীর ফুটপাতে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে নগরীর পথচারীরা। আর এসব দেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন জেনেও না জানার ভান করছে।
রাজধানীতে ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধ হলেও এ অনিয়মের চর্চা সবচেয়ে বেশি হয় প্রশাসনিক ভবনগুলোর সামনে। পথচারীদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে ফুটপাতেই একের পর এক বসানো হচ্ছে পুলিশ বক্স। অনেকে আবার নিজেদের অপকর্ম জায়েজ করতে ফুটপাতকেই বানিয়ে নিচ্ছেন নামাজের স্থান। রাজধানীর ফুটপাত দখলমুক্ত করতে না পারার পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর দায়ও কোনো অংশেই কম নয় বলে মনে করেন নগরবাসী। রাজধানীতে ফুটপাত দখলমুক্ত করার কাজে সমন্বয়হীনতা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একদিকে সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযান অন্যদিকে ফুটপাত দখল করে একের পর এক বসানো হয়েছে পুলিশ বক্স।
এটাই সত্য যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি ফুটপাত দখল করে তাহলে আমাদের জন্য সেটি দুর্ভোগ। কারওয়ান বাজারের ওয়াসা ভবনের সামনের ফুটপাতে। জীবনযুদ্ধে এখানে বাসের সঙ্গে টেক্কা দিতে হয় পথচারীদের। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি নয় পুলিশ। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকাজুড়ে ফুটপাতে দোকানের আধিক্য অসহনীয়। ফুটপাতগুলো হকাররা দখল করে ব্যবসা করলেও এর নেপথ্যে আছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। রাজধানীর হকাররাও এসব সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। প্রতিদিনই চলছে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি। কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে তাদের এ আধিপত্য। যে কারণে বারবার উচ্ছেদ করার পরও দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না ফুটপাতগুলো। ফুটপাত দখল করা হকারদের কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। পথচারীদের চলাচলের জন্য থাকা ফুটপাতে কেন আপনাদের দোকান এমন প্রশ্নের জবাবে খিলক্ষেত ফুটপাতের দোকানি শফিকুল ইসলাম বলেন, টাকা দিয়ে দোকান বসাইছি, আবার প্রতিদিন চাঁদাও দিতে হয়। মানুষও হাঁটুক আমাদেরও ব্যবসা হোক। ফুটপাতে দোকান না বসালে কই যামু, বাজারে দোকান-ঘর নেয়ার মতো তো পুঁজি নাই। তাই প্রতিদিন লাইনম্যানকে টাকা দিয়ে দোকান চালাই।
ফার্মগেটে ফুটপাতে শীতের কাপড়ের দোকানদারি করে এমন একজন ভাসমান ব্যবসায়ীর বক্তব্য হলো- সাত বছর ধরে এখানে দোকান চালাই। মৌসুম বুঝে বিভিন্ন ব্যবসা করি। ব্যবসার খাতিরে দোকান চালাতে গিয়ে অনেকবার উচ্ছেদ হয়েছি, কিন্তু আবার ফিরে এসেছি। নগদ টাকা লাইনম্যানকে দিয়ে ব্যবসা করে টিকে আছি। তিনি বলেন, ফুটপাত আসলে মানুষের হাঁটার জন্য, কিন্তু আমরা এখানে দোকান বসিয়ে ব্যবসা করে খাচ্ছি। আমাদের দোষ দিয়ে লাভ নাই। কারণ এখানে অনেক শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে, যারা প্রতিদিন চাঁদা নেয়। যে কারণে বারবার উচ্ছেদ অভিযানের পরও আমরা ফিরে এসে আবার দোকান নিয়ে বসতে পারি। যারা দখল করে রেখেছে তাদের কাছে ফুটপাত দখলমুক্ত যারা করতে চায়, তারা কিছুই না।
প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদা যে ফুটপাত থেকে ওঠায় ক্ষমতাসীন বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী আর পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা, সেই ফুটপাতে শার্ট, প্যান্টের ছোট দোকানের জন্য প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত আর জুতা ও আরেকটু বড় দোকানের জন্য ২০০ থেকে ২৫০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় তাদের। কিন্তু এসব টাকা মূলত কাদের হাতে যাচ্ছে এর উত্তর দিতে নারাজ তারা। তাদের ভাষায়, তারা শুধু লাইনম্যানকেই চেনে, যারা এসে প্রতিদিন টাকা নিয়ে যায়।
আর এই ফুটপাত মুক্ত করতে না পারার দায়ে দায়ি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বরাবরের ধারাবাহিকতায় নির্লজ্জের মত বলেছেন, ‘ঢাকা শহরকে সুন্দর করার জন্য পুলিশ বক্সসহ ফুটপাত থেকে অবৈধ সবকিছু সরিয়ে দেয়া হবে।’ এর আগেও তিনি এমন গতানুগতিক কথা তিনি গণমাধ্যমের সাথে বলেছেন, কিন্তু পরে গিয়ে দেখা যায় ‘ যেই সেই।’ মেয়র থেকে কাউন্সিলর-রাজনীতিক-প্রশাসনিক কর্তাদের কোন না কোন যোগ সাজশ আছে বলেই ব্যস্ততম সড়ক ও ফুটপাতে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধ হলেও সচিবালয়ের আশপাশে প্রশাসনিক ভবনগুলোর সামনে আইন না মানার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। আর এমন নিদারুণ ফুটপাত দখলের কারণে আজ ফুটপাত ব্যবহার করার কোনো উপায় নেই তো। কারণ ফুটপাত সব দখল করে রাখছে বিভিন্ন দোকান। ভবনের নিচে যতগুলো পার্কিং আছে তার চেয়ে বেশি গাড়ি।
আকাশ-সড়ক- রেল ও নৌ পথকে দুর্ঘটনামুক্ত করার লক্ষ্যে সচেতনতামূলক স্বেচ্ছাসেবি দেশের একমাত্র সংগঠন সেভ দ্য রোড-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, হাঁটার নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ না থাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের মধ্যে পথচারীদের সংখ্যাই বেশি। অপর্যাপ্ত ও হাঁটার অনুপযোগী ফুটপাত এবং রাস্তা পারাপারের তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পথচারীদের আগ্রহ থাকার পরও তারা হাঁটতে পারছেন না। পথচারীদের হাঁটার পরিবেশ না থাকায় বাধ্য হয়ে তাদের মূল রাস্তা ব্যবহার করতে হচ্ছে। আর হচ্ছে দুর্ঘটনা। বাড়ছে নিহত ও আহতের সংখ্যা। শুধু এখানেই শেষ নয়; ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে না পারায় প্রতি বছর সংগঠিত দুর্ঘটনার ২০ ভাগ ঘটেছে ২০২১ সালে। যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে একদিকে যেমন প্রাণহানী ঘটবে, অন্যদিকে বাড়বে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে ফুটপাত দখল করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার প্রবণতা।
২০০০ সাল থেকে বলে আসছি- লিখে আসছি যে, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে রাষ্ট্রকে কার্যত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দাবি জানিয়ে আসলেও টনক নড়েনি বিএনপি-জামায়াত সরকারের, টনক নড়েনি গত ১৩ বছরের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারেরও। কিন্তু কেন? কারণ এটাই যে, যদি ফুটপাত দখলমুক্ত হয়ে যায় তাহলে আর টোকাই শ্রেণির রাজনীতিকরা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হতে পারবে না, টাকার রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারবে না আওয়ামী লীগের গত ১৩ বছরের রাঘব বোয়াল বনে যাওয়া অন্ধকারের চুনোপূঁটিরা। তাতে করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ছাত্র-যুব-জনতা। এভাবে যদি চলতে না চান? চালাতে না চান বাংলাদেশ? তাহলে লোভ মোহহীন নিরন্তর রাজপথে আসুন আওয়াজ তুলুন- ‘ফুটপাত দখল মুক্ত চাই, চাই- ‘নাইট মার্কেট’ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে হকারদেরকে স্থায়ি ব্যবসা করার ব্যবস্থা করতে হবে।’
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি