গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সর্বজন পরিচিত কবি ও কথাসাহিত্যিক টি.এম মনোয়ার হোসেন। তিনি ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৭৮ সালের ১২ নভেম্বর নানার বাড়ীতে তাঁর জন্ম। মা মনোয়ারা বেগম এবং বাবা মো. বদিউজ্জামানের কোল জুড়ে আসে প্রতিভাবান এ কবি। তাঁর লেখাপড়া এ গ্রামেই শুরু হয়। হঠাৎ মায়ের মৃত্যুতে তাঁকে দাদার বাড়ি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের তরনীপাড়ায় চলে আসতে হয়। ফুটবল পাগল বাবা বদিউজ্জামান তাঁর স্ত্রী মৃত্যুতে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন। অথৈ সাগরে ভাসতে থাকেন। ছেলে-মেয়ের লালন পালন ও লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় বিয়ে করতে রাজী হন। সংসার আর সন্তানের দিকে তাকিয়ে খেলাধূলার সমাপ্তি ঘটান। কিন্তু সংসারে এক দৈত্যের মত অভাব এসে চেপে বসে।
আগেই বলে রাখা ভালো টি.এম মনোয়ার হোসেন ওরফে মিন্টু মিয়া নামেই বেড়ে ওঠে তার নিজ গ্রামে। অভাব-অনটনের কারণে গ্রামেও বেশি দিন থাকেননি। গোবিন্দগঞ্জ থেকে সোজা পশ্চিমে ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরে কৌচাকৃষ্ণপুর গ্রামে। সেখানেই মানুষের বাড়িতে লজিং মাষ্টার থেকে ১৯৯৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করে ‘পলাশবাড়ী সরকারি মহাবিদ্যালয়ে’ এইচএসসিতে ভর্তি হন বিজ্ঞান বিভাগে। এখানে এসেও থাকাণ্ডখাওয়ার অভাব প্রকটভাবে দেখা দেয় তাঁর জীবনে। তাই সেখানেও এবাড়ি ওবাড়ি লজিং মাষ্টার থেকেই পড়াশুনা চালিয়ে যান। ১৯৯৫ সালে ২য় বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন।
এ ফলাফল দিয়ে আর মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি তিনি। পলাশবাড়ীতে আবার বিএসসিতে ভর্তি হন। ১৯৯৮ সালে ২য় বিভাগ নিয়ে বিএসসি পাশ করেন। বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়া করলেও ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে ছিল অবাধ বিচরণ। এসময়ের মধ্যেই তার বেশ কয়েকটি ছোট গল্প ও ২০০-২৫০-এর মত কবিতা লিখে ফেলেন, হাত দেন উপন্যাসে। ২০০০ সালে লিখে শেষ করেন ‘এ কেমন পৃথিবী’ তার প্রথম উপন্যাস। তারপর কিশোর উপন্যাস ‘পরীর রাজ্যে আমি’ ‘সাত সমুদ্র তের নদী’ এবং বেশ কয়েকটি নাটক। এর ফাঁকে চলতে থাকে সংগীত চর্চাও। একটা হারমোনিয়ামের অভাবে সংগীতে বেশি দূর এগুতে পারেননি তিনি। তবে অনেক সংগীত প্রশিক্ষকের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বটে। কিন্তু সংগীতে তেমন ভাল করতে পারেননি পলাশবাড়ী থাকাকালীন। তবে বাংলা সাহিত্যে এগিয়ে গিয়েছিলেন অনেক দূর। কিন্তু প্রকাশ বিমূখ মানুষ হওয়ায় তা প্রকাশের জন্য কারো কাছে যাননি। তবে ২০০০ সালে ‘আজকের কাগজ’ নামক এক জাতীয় দৈনিক এ ‘শ্রেষ্ট জাতি’ কবিতাটি প্রকাশ পায়। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, একের পর এক স্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘অনড়’ পত্রিকায় ও ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেয়ে আসছিল তার কবিতা এবং গল্প।
উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলা সাহিত্যে ‘রংপুর কারমাইকেল কলেজ’ এ এমএ ক্লাসে ভর্তি হলেও তাঁর আর পরীক্ষা দেয়া হয়ে ওঠেনি। এখানেই তার পড়ালেখার সমাপ্তি ঘটে। পেটের চিন্তায় তাকে ‘প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র’ নামক এক এনজিওতে যোগ দিতে হয় ‘মৎস্য কর্মী’ হিসেবে। পাড়ি জমান রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলায়। সেখানে ২০০০-২০০১ পর্যন্ত নিষ্ঠার সাথে চাকুরী করেছেন। ফিরে আসেন আবার পলাশবাড়ীতে। ‘জিনিয়াস কোচিং সেন্টার’ খুলে পড়াতে থাকেন ষষ্ঠ থেকে ডিগ্রী’র শিক্ষার্থীদেরকে। তবে বেশি দিন তাকে এ কোচিং চালাতে হয়নি। ভাগ্যান্বেষণে পঞ্চগড়ে চলে আসেন এক শিক্ষকতার চাকুরী নিয়ে। যোগদান করেন ‘সাতমেড়া ফুলবাড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ এ বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে। কিছুটা সুবিধা করে নিয়ে বাবা আর দ্বিতীয় মা আসমা বেগমসহ পঞ্চগড় এ বসবাস করতে থাকেন। এরইমধ্যে তার প্রথম উপন্যাস ‘এ কেমন পৃথিবী’ ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। ঢাকা বই মেলাসহ সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর বই এবং সেই সাথে পরিচিতও হতে থাকেন এ কবি। এতেই থেমে থাকেননি তিনি অনেক নবীন-প্রবীন, জ্ঞানী-গুণী কবি-সাহিত্যিকগণের সাহচর্যে আসার সুযোগও পান। পরিচিত হন সারা বাংলায় প্রতিষ্ঠিত কিছু সাহিত্য সংগঠনের সাথে। কিন্তু ৬ বছরের মাথায় এ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের চাপে ছাড়তে হয় এ শিক্ষকতার চাকুরিও। হতাশ হয়ে পড়েন কবি টি.এম মনোয়ার হোসেন।’ বাবা-মাকে নিয়ে ভাসতে থাকেন অথৈ সাগরে। কিছুদিন কর্মহীন হয়ে থাকার পর ভাগ্যে জোটে আর একটি শিক্ষকতার চাকুরি। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন পরিচালিত ‘কালেক্টরেট আদর্শ শিক্ষা নিকেতন’ এ মাধ্যমিক শাখায় বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আজ পর্যন্ত এ বিদ্যালয়েই নিয়োজিত আছেন এবং সুন্দর ভাবে জীবন যাপন করছেন। তবে ২০১৭ সালে মা আসমা বেগম মারা যান এবং বাবা বদিউজ্জামান ২০১৮ সালে পৃথিবী ছেড়ে ওপাড়ে পাড়ি জমান। সকল দুঃখ ভুলে শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সাহিত্য চর্চা। তার হাতে গড়ে তোলেন সারা বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে ‘ধূমকেতু সাহিত্য পরিষদ, পঞ্চগড়’। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন গুণী সাহিত্যিকগণকে নিয়ে সাহিত্য মেলার আয়োজন করেন প্রায় ২ বছর অন্তর অন্তর। এ মেলায় যোগ দেন দেশের বিভিন প্রান্ত থেকে কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-নাট্যকার-গীতিকার-সুরকার ও সংগীতশিল্পীগণ। ধূমকেতু সাহিত্য পরিষদ, পঞ্চগড়-এর গুণীদের সাহচর্যে এসে তিনি লিখে চলেছেন একাধারে কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, শিশুতোষ ছড়া, গান ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় পত্র-পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে। ২০২০ এ ‘কালি ও কলম’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল ‘চামড়া’ নামক একটি ছোট গল্প। এ গল্প সাহিত্য প্রেমীদের মন জুগিয়েছে বেশ। এ পর্যন্ত টি.এম মনোয়ার হোসন-এর একক গ্রন্থ ১২টি এবং যৌথ গ্রন্থ প্রায় ১২০ টির মত প্রকাশিত হয়েছে।
শুধু সাহিত্য চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। তিনটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন সফলভাবে। সম্পাদনা (ম্যাগাজিন)- রক্তে ভেজা বাংলা, দিপীকা, ভেলা ‘ভেলা’ অবশ্য অনিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে দেশের ও বিদেশের কবি সাহিত্যিকগণের লেখা নিয়ে।
শিক্ষকতা পেশায় আসার আগে সাংবাদিকতা পেশাই বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর লেখালেখিতে ভাঁটা পড়বে ভেবেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন স্বেচ্ছায়। এখন শিক্ষকতা, সাহিত্য চর্চার সাথে গানও লিখছেন। এ পর্যন্ত আধুনিক, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, বিচ্ছেদ, বাউল ও দেশের গান মিলে প্রায় ২৫০টিরও বেশি গান রচনা করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দক্ষ ও সুনামধন্য কণ্ঠ শিল্পীদের কন্ঠে বেজে চলেছে গীতিকার টি.এম মন্য়োার হোসেন-এর নতুন নতুন গান।
তবে করোনাকালীন সময়ে বাসায় বসে বসে লেখা তার পরবর্তী প্রকাশের জন্য কয়েকটি বইয়ের তালিকাণ্ড দমকা হাওয়ায় (পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ), কেতুমিয়ার ভিজিট কম (কাব্যাপোন্যাস ২য় খন্ড), ছড়া ও ছন্দে ভাল ও মন্দে (২য় শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ), মেঘের ভেলায় ছড়ার মেলা (৩য় শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ), ছড়ার বেশে সোনার দেশ, ছন্দে ছন্দ লাগবে বেশ (৪র্থ শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ), নীল রং, নীল বেদনা (৪র্থ গল্পগ্রন্থ)। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর জীবনী নিয়েও লিখে চলেছেন (নজরুল ও তাঁর নিন্দুকেরা) নামক প্রবন্ধগ্রন্থ।
তিনি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কবিতা সংসদ, পাবনা কর্তৃক সম্মাননা পদক-১৪১৬। নজরুল সাহিত্য পরিষদ, রাণীরবন্দর, চিরিরবন্দর, দিনাজপুর কর্তৃক নজরুল স্মারক সম্মাননা-২০১০। প্রতিভা সাহিত্য, সংস্কৃতিও সামাজিক সংগঠন, চিলাহাটি, নীলফামারী কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা-২০১১। বাংলা সাহিত্যিকী, রাজশাহী কর্তৃক ভাষা সৈনিক সাহিত্য পদক-২০১১। নজরুল পাঠাগার ও ক্লাব, রাণীরবন্দর, চিরিরবন্দর দিনাজপুর কর্তৃক রবীন্দ্র-নজরুল জন্ম-জয়ন্তী উৎসব স্মারক সম্মাননা-২০১২। নওগাঁ লেখক পরিষদ ও লেখক ফোরাম, আত্রাই, নওগাঁ কর্তৃক সাহিত্য পদক-২০১৬। পঞ্চগড় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, পঞ্চগড় কর্তৃক সাহিত্য সম্মাননা-২০১৭।
তাঁর গল্প, নাটক, কবিতা, উপন্যাসে এভাবেই উঠে আসছে গ্রাম-বাংলার মানুষের দুঃখ-কষ্ট, বিরহ-বেদনা, হাসি-কান্নার গল্প, চিত্রিত হচ্ছে এদেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অপার সৌন্দর্য আর ফুটে উঠছে দেশপ্রেম। তার যে কোনো একটি বই পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠাই ভার হয়ে পড়ে। ডুবে যায় যে কোনো পাঠক গল্পের গভীর থেকে আরও গভীরে সাহিত্যরস আহরণ করতে। টি এম মনোয়ার হোসেন এমন একজন কথা সাহিত্যিক তিনি সর্বস্তরের মানুষের খুব কাছে গিয়ে তাদের জীবনের গল্প সংগ্রহ করেন, দুঃখীর দুঃখ দেখেন নিজ চোখে, তবেই তিনি গড়ে তোলেন এক একটি কাহিনী, কবিতা কিংবা উপন্যাস। সাধারণ জনপদই তাঁর লেখার মূল উপাদান।
তাঁকে মানবিক কবি কিংবা কষ্টের ফেরিওয়ালাও বলা হয়। মানুষের কষ্ট দেখলে নিজেই কেঁদে ওঠেন, পাশে গিয়ে দাঁড়ান। শুধু পাশে দাঁড়িয়েই তিনি ক্ষ্যান্ত নন, সাধ্যমত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তাদের দিকে। এমন দৃষ্টান্ত আছে অনেক। কিন্তু প্রতিভাবান এই কবি ও কথা সাহিত্যিকের সঠিক মূল্যায়ন অভাবে উৎসাহে অনেকটা ভাঁটা পড়েছে। তাই তিনি মানব দরদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেক নজর কামনা করেন।