অপরাধ আছে বলেই আইন হয়েছে। অপরাধ বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হচ্ছে আইনের ধারারও। তারপরও থেকে নেই অপরাধ। তবে অপরাধের মাত্রা কমবে এমনটাই প্রত্যাশা। ইতিহাস বলে একসময় প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে ছিল না কোন আইন বা শাসক। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করায় সমাজের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই আইন বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সৃষ্টি। তবে শৃঙখলা বাহিনীর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য ব্যক্তিই দায়ী। ব্যক্তির অপরাধ কোন গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, বাহিনী বা রাষ্ট্রের উপর বর্তায় না। সমাজে অপরাধের পাশাপাশি অনেক ভাল কাজও রয়েছে সেই ভালর কৃতিত্ব সকলকে দেওয়া যায় না। সুতরাং অপরাধ যার কর্মও তার।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে খুন হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনার পাঁচদিন পর ওই বছরের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামি এবং টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে দ্বিতীয় আসামি করে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব।
বহুল আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্থ হওয়া পরিদর্শক লিয়াকত আলী এবং টেকনাফ থানার বরখাস্থ হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন আদালত। সোমবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেল সোয়া ৪টার দিকে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল এ রায় ঘোষণা করেন। এদিন সারাদেশ তাকিয়ে ছিল কক্সবাজারের দিকে। কিন্তু কেন? কারণ এটি ছিল একটি ছবির মত ঘটনা। একজন পুলিশ অফিসারের কাজ যেখানে জনগণের শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সেখানে তার ব্যতিক্রম হয়েছিল। একজন মেজরকে যেখানে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয় সেখানে জনগনের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাই সকলের মত আমিও তাকিয়ে ছিলাম রায়ের দিকে।
এই হত্যাকান্ডের সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থাহীন হয়ত হয়েছেন অনেকে। তবে আমার মনে হয় সেই জায়গা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি। কারণ সঠিক বিচার হয়েছে। পুলিশ বাহিনী করোনাকালে অভিভাবকের চেয়েও দায়িত্বপূর্ণ কাজটি করেছে। করোনারোগীর নিজের আত্মীয় যে কাজটি করতে পিছুপা হয়েছে সেই কাজটি করে দিয়ে পুলিশ। আত্মীয়স্বজন যেখানে জীবনের ঝুঁকি নেয় নি, মানবতা ও সামাজিকতা যেখানে মুখ থুবরে পরেছিল সেখানে পুলিশ বাহিনী ছিন্ন করেছে জীবনের মায়া। বিচ্ছিন্ন করেছে পরিবারের চাওয়া। বাঁচিয়েছে অনেক করোনারোগীর জীবন-স্বপ্ন। করোনায় আক্রান্ত হয়েছে অনেক পুলিশের জীবন। আর পৃথিবী ছেড়ে চলেও গেছেন অনেকে।
পুলিশতো মানুষ বটে কিছু নয়। আর মানুষের মধ্যেইতো ভাল-মন্দ থাকে বা আছে। শুধু পুলিশ নয় জগতের সকল পেশার মানুষের মধ্যেই ভাল-মন্দ আছে থাকবে। তাই একটি ভাল কাজ দেখে সকলকে আমি মূল্যায়িত করতে পারি না আবার একটি খারাপ কাজ দিয়ে সকলকে খারাপ বলব এই মতের আমি বিশ্বাসী নয়।
পুলিশ সদর দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে করোনাকালে গত বছরের ১৩ জুলাই পর্যন্ত ১২ হাজার ৭৮০ জন পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৫০ জন। পরে এই তথ্যের সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। মৃতদের মধ্যে কনস্টেবল থেকে শুরু করে এসপি পদমর্যাদার পুলিশ সদস্য রয়েছেন। এ ছাড়া কোয়ারেন্টিনে ১৩ হাজার ৮০৪ জন এবং আইসোলোশনে ছিলেন ৫ হাজার ২ জন পুলিশ সদস্য। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯ হাজার ১৯০ জন। যাদের বেশিরভাগই কাজে ফিরে গেছেন। করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের সদস্য রয়েছেন ২ হাজার ৪৪৪ জন। জীবনবাজি রেখে দেশের ও দেশের মানুষের জন্য এমন দায়িত্ব নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বিশ্বময় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকে জনগণের পাশে ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। জনগণকে নিরাপদ রাখতে সম্ভাব্য সবকিছু করেই ফ্রন্ট-ফাইটার বা সম্মুখযোদ্ধা খেতাব পেয়েছেন পুলিশের অকুতোভয় সদস্যরা। প্রতিবেদনে দেখেছি গাজীপুর মহানগরীর সাইনবোর্ড এলাকায় দিবাগত রাত ২টার দিকে এক পথচারীর মৃত্যুর পর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত সন্দেহে কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য রুবেল মিয়া এগিয়ে আসেন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজে ভ্যান চালিয়ে নিহতের লাশ থানায় নিয়ে যান। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ আজ করোনার আক্রমণে বিপর্যস্থ ও বিধ্বস্থ। অজানা, অদেখা, কায়াহীন শত্রু করোনার আক্রমণ থেকে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করাই এখন রাষ্ট্রের এক নম্বর প্রধান কাজ। এ মুহূর্তে করোনার আক্রমণ থেকে বাঁচার একমাত্র মূলমন্ত্র সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং যথাসম্ভব ঘরে থাকা। নিশ্চিতকল্পে শুরু থেকে বাংলাদেশ পুলিশ যেভাবে মাঠে-ময়দানে কাজ করছে অন্য সময়ে সামাজিক অপরাধ দমন সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু আজ জাতির এই কঠিন সংকটে পুলিশ সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশিত স্বমূর্তিতে যেভাবে ভূমিকা রাখছে তা এক কথায় অসাধারণ। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা শুধু যে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মানুষকে ঘরে রাখা নিশ্চিতকল্পে কাজ করছে তাই নয়। সব রকম মানবিক সহায়তা নিয়ে তারা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে হাজির হচ্ছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে নেওয়া, কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা এমনকি মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনও করছে পুলিশ। করোনা পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীর মানবিকতার বিষয়গুলো মানুষকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। নতুন পথ দেখিয়েছে। নতুন এক পুলিশ বাহিনীকে চিনতে শুরু করেছে। বিশেষ করে লকডাউন শুরুর দিন হতে পুলিশ বাহিনীর কর্মতৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এই দুঃসময়ে তারা মাস্ক, স্যানিটাইজার ও খাবারের প্যাকেট বিলি করেছেন এবং করে যাচ্ছে। রাতের আধাঁরে অনাহারীর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। প্রসববেদনায় ছটফট করা নারীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছে। তাঁদের মধ্যেও যে মানবিকতা, উদারতা, মনুষ্যত্ববোধ আছে, তা করোনা দেখিয়ে দিয়েছে।
শুধু করোনাকালেই নয়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজানে সশস্ত্র জঙ্গিদের হামলায় পুলিশের ভ’মিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। গুলশান ঘটনার আগে ২০১৩ সাল থেকে জঙ্গিরা দেশব্যাপী উদারমনা এবং ভিন্নধর্মাবলম্বীদের ওপর টার্গেট কিলিং চালিয়ে কয়েক ডজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। সে সময়ে দেশি-বিদেশি কিছু পক্ষ ও গোষ্ঠী উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করতে থাকে বাংলাদেশে আইএসের মতো ভয়ঙ্কর সব জঙ্গি গোষ্ঠীর উপস্থিতি রয়েছে। যা বাংলাদেশের একক প্রচেষ্টায় দমন করা সম্ভব নয়। সে ছিল আরেক মহাদুর্যোগের সময়। সেই দুর্যোগ মোকাবিলায়ও পুলিশ বাহিনী অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়াও কোথাও সংঘর্ষ, মারামারি, দুর্ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যা-ই ঘটুক, তা সামাল দিতে সবার আগে পুলিশ পৌঁছে যায়। এটা পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ বাহিনীর হাজারো সদস্য ২৪ ঘন্টায় ১৬ থেকে ২০ ঘন্টা ডিউটি করে আমাদের নিরাপত্তার জন্যে। আমরা যখন রাতে ঘুমিয়ে পড়ি তখন তারা রাতের ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। সামান্য একটু রোদে কিংবা বৃষ্টিতে আমরা যখন নিরাপদ আশ্রয়স্থলে ছুটে যাই, তখন রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে পুলিশ বাহিনী দায়িত্বপালন করে। দেশের জনগণের কথা বিবেচনা করে পরিবার-পরিজন রেখে শুধু দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই এ বাহিনীর সদস্যরা সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
এই হত্যার সুষ্ঠু বিচার হতে পারে পুলিশের প্রতি আস্থা রাখার একটি অনন্য উদাহরণ। কারণ ওসি প্রদীপ নিতান্তই পুলিশের একজন কর্মকর্তা। তাকে দিয়ে দেশের সকল ওসির তুলনা হতে পারে না। তবে ওসি প্রদীপের রায় হতে পারে বাকি ওসিদের জন্য সর্তক বার্তা। রাষ্ট্রের আইনের উর্দ্ধে কেউ নয় আর অপরাধ করলে শাস্তি অনিবার্য এই কথাটি মাথায় রাখলে আমার মনে হয় আমরা শান্তির সাথে বাস করতে পারব। ওসি প্রদীপ যত টাকা জমিয়েছে তা দিয়ে কত দিন চলবে? অবৈধভায়ে জমিয়ে সে শেষ পর্যন্ত কি ভোগ করতে পারলেন? কথায় বলে সততার টাকা সহজে শেষ হয় না। আর অবৈধ টাকা আসতেই দেখা যায় যেতে দেখা যায় না। কথাগুলো মনে হয় যথাযুক্ত। প্রতিবেদনে দেখেছি ওসি প্রদীপের স্ত্রীও না কি আদালতে আসেনি? স্বামীর মৃত্যুরবাণী টিভিতে দেখতে হয়েছে বলতে পারে নি নিজের প্রতিক্রিয়া দিতে পারেনি স্বামীকে শান্তনা। এর থেকে কষ্টের কিছু পৃথিবীর বুকে আছে কি না আমার জানা নেই। জীবনের শেষ সময়ের কথা আমরা যদি একটু ভাবি মনে হয় আমরা অনেককিছু থেকে বিরত থাকতে পারি। পারি সুখী-সুন্দর জীবন গড়তে। ওসি প্রদীপের রায়ে অবশ্যই ন্যায়ের ও অপরাধ কাউকে ক্ষমা করে না এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। এটি ন্যায়ের দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে এমন দৃষ্টান্ত আর দেখব না এই প্রত্যাশাই রইলাম।
লেখক: গোপাল অধিকারী, সাংবাদিক।