প্রত্যেক মানুষের একটি নিজস্ব জগত থাকে, স্বপ্ন থাকে। তার স্বপ্ন ও জগতকে ঘিরে পল্লবিত হয় তার পরিবারের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা। কিন্তু নানা কারণে মানুষ এখন তাদের স্বপ্নকে বিসর্জন দিচ্ছে বা দিতে বাধ্য হচ্ছে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মাধ্যমে। আত্মহত্যার মাত্রা দেশে এতোটাই বেড়ে গেছে যে তা বেশ দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা যায়, ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, করোনাকালীন প্রথম ১৫ মাসে ১৫১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে ৪২ জন শিক্ষার্থীই সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের, ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজের শিক্ষার্থী, ২৯ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী ছিলেন। যারা এমন অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন তাদের মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আছেন সাতজন শিক্ষার্থী। কর্মসংস্থানের অভাব, পারিবারিককলহ, ব্যক্তিগত নানা কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছেন বলে আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় উঠে এসেছে।
ভয়ানক হারে এভাবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ এমনকি মেডিক্যালের শিক্ষার্থীরাও আত্মহত্যা করছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানসিকভাবে ভেঙেপড়া, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, মাদকাসক্ত, আর্থিক সঙ্কট, হতাশা, পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, চাকরি নিয়ে হতাশাসহ নানা প্রভাব থেকেই শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। গত বছরের মার্চ মাস থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত আট মাসে অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
আত্মহত্যা শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বিভিন্ন বয়সের মানুষ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এই ভয়ানক ব্যাধির কবলে আক্রান্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের জরিপ বলছে, বাংলাদেশে বছরে আত্মহত্যা করছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। গড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন ৩৫ জন। এর মধ্যে যেমন শিক্ষার্থী আছে, আছেন বিত্তবানরাও। সম্প্রতি ঢাকায় ফেইসবুক লাইফে এসে আবু মহসিন খান নামের এক ব্যবসায়ীর নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা দেশের মানুষকে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে। আত্মহত্যার আগে লাইভে যেসব কথা বলেছেন সেখানে উঠে এসেছে নগর জীবনের নিঃসঙ্গতার কথাও। একইভাবে গত বছরের ১৭ আগস্ট মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের গয়ঘর এলাকায় সুমন নামের এক যুবক ফেইসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেন। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে ফেইসবুক লাইভে এসে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন পুবাইলের স্বপন চন্দ্র দাস নামের এক ব্যবসায়ী। ৭ ডিসেম্বর সবুজ সরকার নামে কুমিল্লার এক তরুণ ফেইসবুক লাইভে এসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
আত্মহত্যার কারণ উপস্থাপন করে আসছেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণী মানুষ। কারণগুলো প্রায় সবার জানা। কিন্তু কারণগুলোর ব্যবচ্ছেদ করে সমস্যার সমাধানে খুব একটা সফলতা অর্জিত হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যা হচ্ছে একজন মানুষের জন্য চরমপন্থা। কেউ যখন তার সামনে কোনো আশা বা বেঁচে থাকার সার্থকতা দেখতে না পান, তখন এ পথ অবলম্বন করেন। যদিও আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। একজন তরুণ শত বাধা অতিক্রম করে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে এসে যখন দেখেন বেকারত্ব, হতাশা এবং বৈষম্য তাকে ঘিরে ধরেছে, তখন তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে থাকে না। আত্মহত্যার আগে কিন্তু তিনি অনেক ভেবে থাকেন। কিন্তু সমাধান পান না। এ চিত্র সমাজের সর্বত্রই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা সমাজের ভয়ঙ্কর ব্যাধির প্রকাশ। এজন্য কাউন্সিলিংয়ের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা শিশু, কিশোর ও যুবকদের মধ্যে সুন্দর জীবনের পথ দেখাতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
করোনা মহামারীতে আত্মহত্যার প্রবণতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ শুধু ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে ২ হাজার ১৬৬টি। বিবিএস বলছে, করোনার প্রথম বছর আত্মহত্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। মোট আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৪ হাজার ৪৩৬টি। করোনার সময় নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।
মানুষ সুন্দর জীবনকে উপেক্ষা করে কেন আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে। বিশেষকরে শিক্ষার্থীরা কেন তাদের জীবনের সোনালি সময়ে জীবনকে ছুটি দিয়ে দিচ্ছে--এর কারণ খুঁজে বের করে তা সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের ভাষ্য, শ্রেণিকক্ষে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দেয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এসে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে কেন, এটি জরুরি ভিত্তিতে অনুসন্ধান করতে হবে। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো গাফিলতি আছে কি না, পরিবার থেকে কোনো সমস্যা আছে কি না? কেন তারা হতাশায় ডুবছেন? এসবের উত্তর জানা জরুরি। সব আত্মহত্যার কারণ সাধারণীকরণ করলে আবার সঠিক উত্তর আসবে না। যেভাবেই হোক আত্মহত্যার এ পথ বন্ধ করতেই হবে।
আত্মহত্যার লাগামহীন বৃদ্ধি রোধে অনেক বিশেষজ্ঞ তাঁদের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করছেন। বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, হতাশা, ব্যক্তিত্বজনিত সমস্যা এবং বিভিন্ন মানসিক রোগের কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। সময়মতো এই ব্যাধিগুলোর যত্ন নেয়া গেলে, আমরা সহজেই আত্মহত্যার সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারি। এ ক্ষেত্রে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে আত্মহত্যাবিরোধী ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে, তুমি তোমার পরিবারের জন্য বেঁচে থাকবে, ছেলে-মেয়ে থাকলে তাদের জন্য বাঁচবে আর মা-বাবা থাকলে তাদের জন্য বাঁচবে।
এটি স্পষ্ট যে, এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে কেউ চলে যেতে চায় না। সবাই এই পৃথিবীর সৌন্দর্য, মাধুর্য উপভোগ করতে চায়। পৃথিবীর মায়াজালে বন্দি হয়ে থাকতে চায়। তাহলে কেন মানুষ এত আত্মহত্যা করছে? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা আত্মহত্যা করে তারা কেউই মৃত্যু কামনা করে না। বরং তাদের সাথে হওয়া অবিচার থেকে বাঁচতে তারা এটাকে একটা উপায় হিসেবে মনে করে। এদের মাঝে অধিকাংশ মানুষই শেষ সময়ে এসেও বাঁচতে চায়। কিন্তু সেই সুযোগটা তারা আর পায় না। তাই তাদের জন্য একটা কল সেবা চালু করা দরকার যার মাধ্যমে মানুষ চরম হতাশার মধ্যে একটু বাঁচার খোরাক পাবে। যেখানে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট থাকবে যে তাদেরকে জীবনের মূল্য বোঝাতে সক্ষম হবে। তাদের ভেতর জীবনের সৌন্দর্যবোধ জাগিয়ে তুলবে।