বনদস্যু ও জলদস্যু দমন হলেও সুন্দরবনে চোরা শিকারী চক্র দমন হয়নি। আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরা শিকারি চক্র। চোরা শিকারীর দল টার্গেট করছে মায়াবি চিত্রল হরিণ। হরিণ শিকার করে চক্রটি হরিণের মাংস ও চামড়া পাচার করছে বলে একাধিক সূত্রে প্রকাশ। ফলে সুন্দরবনে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ মায়াবী চিত্রল হরিণের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। বন বিভাগসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সুন্দরবনের সম্পদ ও বন্যপ্রাণি রক্ষায় তৎপর থাকলেও একাধিক চক্র বিভিন্ন কৌশলে হরিণ শিকার করে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাংস, চামড়া, মাথা পাচার করছে। মাঝে মধ্যে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড বা পুলিশের হাতে পাচারের সময় ধরাও পড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, হরিণ শিকারের জন্য চোরা শিকারিরা সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের গরিব, লোভী জেলে ও অসাধু বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করে। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত কোস্টগার্ডের পৃথক তিনটি অভিযানে ধরা পড়েছে হরিণের মাংস, মাথা ও চামড়া। কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার লে: এম মামুনুর রহমান জানান, ১৭ ফেব্রুয়ারি কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের অভিযানে হরিণের মাথা, ভূড়ি, পা ও চামড়াসহ মাংস উদ্ধার করেছে।
তিনি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন অধীনস্থ বিসিজি স্টেশন কয়রার একটি টহল দল খুলনা জেলার কয়রা থানাধীন খাসিটানা খাল সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২টি হরিণের মাথা, ২টি চামড়া, ২টি ভূড়ি, ৮টি পা ও ২ কেজি হরিণের মাংস পরিত্যক্ত অবস্থায় জব্দ করা হয়। অভিযানে হরিণশিকারীরা কোস্টগার্ড সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে উদ্ধারকৃত হরিণের মাংস আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে আন্দারমানিক ফরেস্ট অফিসে হস্তান্তর করা হয়েছে। লে: এম মামুনুর রহমান এরআগে জানান, ১৫ ফেব্রুয়ারি কোস্টগার্ডের অভিযানে ১২ কেজি হরিণের মাংসসহ অসিত কুমার সরদার (৫০) নামের একজন হরিণ শিকারী আটক হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন অধীনস্থ বিসিজি স্টেশন কয়রার একটি টহল দল খুলনা জেলার কয়রা থানাধীন বড়আংটিয়ারা এলাকায় একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ১২ কেজি হরিণের মাংসসহ ১জন হরিণ শিকারীকে আটক করেন। আটককৃত অসিত কুমার সরদার (৫০) খুলনার কয়রা উপজেলার বড়আংটিয়ারা গ্রামের নগেন্দ্র নাথ সরদারের ছেলে। এরআগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড পশ্চিমজোনের অভিযানে ৪২ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার হয়। ওইদিন ভোর ৫টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কোস্টগার্ড বেইস মংলার একটি টহল দল বাগেরহাট জেলার মোংলা থানা সংলগ্ন ডাংমারি এলাকায় একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ৪২ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করে। ওই অভিযানে হরিণ শিকারীরা কোস্ট গার্ড সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায়। ফলে কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। জব্দকৃত হরিণের মাংস পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ডাংমারি ফরেস্ট অফিসে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে, ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর কোস্ট গার্ড বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৭টি হরিণের চামড়াসহ ১০ কেজি মাংস উদ্ধার করেছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওইদিন কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের অধিনস্থ বিসিজি স্টেশন পাথরঘাটার চরলাঠিমারা হরিণঘাটা খাল সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব উদ্ধার করেছিল। এ অভিযানেও কোন চোরা শিকারি আটক হয়নি। এদিকে, ১৬ ফেব্রুয়ারি অভয়ারণ্যে অনুপ্রবেশ করে মাছ ধরার সময় সুন্দরবনে বালিরগাঙ এলাকা থেকে বাগেরহাট জেলার মংলা থানার কানাইমারী গ্রামের মৃত আনোয়ার মাতব্বরের ছেলে আবদুস সোবহান ও তার তিন পুত্র রাসেল মাতব্বর, রাহুল মাতব্বর ও আলামিন মাতব্বরকে আটক করে স্মার্ট পেট্রোল টিমের সদস্যরা। এ সময় জেলেদের ব্যবহৃত একটি ট্রলার, জাল, দড়ি, দা, ড্রামসহ ১০০ কেজি মাছ জব্দ করা হয়। এরআগে ১২ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা রেঞ্জ পশ্চিম সুন্দরবন বুড়িগোয়ালিনী বনস্টেশন অফিসের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমান আহরণ নিষিদ্ধ পারশে মাছের পোনা আটক করে তা বিভিন্ন পুকুরে অবমুক্ত করে। ১০ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী বনস্টেশন অফিসের বিশেষ দলের অভিযানে মাছ ও কাঁকড়া আহরণের সময় ১২ জেলে আটক হয়। জেলেদের ব্যবহৃত ৫টি নৌকা, ২০ কেজি মাছ ও ৮০ কেজি কাঁকড়া উদ্ধার করে আভিযানিক দলটি। পরবর্তীতে উদ্ধারকৃত কাঁকড়া নদীতে অবমুক্ত করা হয়। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার জেলেদের দেওয়া তথ্যমতে, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জ সংলগ্ন গ্রামগুলোতে একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ ও হরিণ শিকারি চক্র রয়েছে। এদের অবস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সুন্দরবন পূর্ববিভাগের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ, পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলায়। সূত্রমতে, বাঘ ও হরিণ শিকারীরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে, বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ ও হরিণ হত্যা করে। শিকারিরা বাঘ বা হরিণ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতেই চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাঠায়। তবে স্থানীয়ভাবে একটি বাঘের চামড়ার জন্য শিকারিরা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলেও বিদেশে একটি চামড়া ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় বলে সূত্র জানায়। সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণ শিকারের অন্যতম সদস্য বেলায়েত তালুকদারের কাছ থেকে ২০০৪ সালে নয় ফুট এক ইঞ্চি লম্বা ও তিন ফুট চওড়া একটি রয়েল বেঙ্গল বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়। চামড়াটিতে কমপক্ষে পাচঁটি গুলির দাগ ছিল। ওই বছরই পুলিশ সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রাম থেকে বাঘ ও হরিণ পাচার চক্রের নেতা আবদুল মতিন গাজীকে হরিণের শিং ও অন্যান্য প্রাণির অঙ্গ প্রত্যঙ্গসহ আটক করেছিল। সে সময় ২টি বাঘ ও ১৩টি হরিণের চামড়াসহ তার সহযোগীরা পালিয়ে যায়।
সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে একটি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘের রহস্যজনক মৃত্যু হলে জেলেদের মাধ্যমে খবর পেয়ে গতবছর ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা রেঞ্জের বনকর্মীরা চুনকুড়ি রাজাখালী খালের পাশ থেকে বাঘটির মৃতদেহ উদ্ধার করে। প্রত্যক্ষদর্শী জেলে সাইফুল ও মোমতেজকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বন বিভাগের কর্মীরা দাঁত ও নখ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাঘের অর্ধগলিত মৃতদেহ পান। স্থানীয়দের ধারণা, হরিণ শিকারি চক্রের পাতা ফাঁদে বাঘটির মৃত্যু হয়। সাইফুল ও মোমতেজ জানান, মাছ শিকারের সময় দুর্গন্ধ পেয়ে জঙ্গলের গহিনে ঢুকে বাঘের মৃতদেহটি দেখতে পান। ধারণা করা হচ্ছে বাঘটিকে জালে আটকে হত্যার পর দাঁত ও নখ নিয়ে গেছে শিকারিরা। সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এমএ হাসান জানিয়েছিলেন, বাঘ সাধারণত ১৩ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে। বয়সের কারণে বাঘটির মৃত্যু হয় বলে তাদের ধারণা।
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাবাসী জানান, শিকারিদের হাত থেকে প্রাণিদের রক্ষা করতে বনবিভাগের কর্মকর্তারা তৎপর থাকলেও চোরা শিকারিরা মাছ বা কাঁকড়ার পাস নিয়ে বনে ঢুকে জাল পেতে স্প্রিং বসানো ফাঁদ, বিষটোপ, কলার মধ্যে বঁড়শি ঝুলিয়ে এবং চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে নিধন করা হয়ে থাকে বিপুল সংখ্যক হরিণ। শিকারীদের শিকার করা হরিণের মাংস, চামড়া পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। আবার হরিণের ২-৪ কেজি মাংস পাঠিয়ে করা হয় নানা কাজের তদবীর। হরিণের চামড়ারও কদর রয়েছে। একটি চামড়া ৫-৭ হাজার টাকা বিক্রি হয় বলে জানায় সূত্র।
সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনে ক্রমেই বাড়ছে চোরা শিকারির সংখ্যা। এজন্য অর্থনৈতিক কারণকেই দায়ী করেন তিনি। তিনি বলেন, আগে সুন্দরবনে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যেতো। এখন লবণাক্ততার কারণে সে অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। মাছ ধরা ছেড়ে অনেক মাঝিরা চোরা শিকারি হচ্ছে। লবণাক্ততার কারণে গোলপাতা ও গরান বন ধ্বংসের পথে, ফলে বাওয়ালীরাও মাঝিদের পথ অনুসরণ করছে।