বাংলা ভাষায় কথা বলছি- যুগের পর যুগ। বাংলা একাডেমির বইমেলায় আমাদের প্রাণের সম্মিলন ঘটে তাও যুগের পর যুগ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বিশ^ব্যাপী আলোচিত ভাষা আমাদের বাংলাদেশের বাংলা ভাষা। সেই বাংলা ভাষাকে কারা বৃহ্নলা ভাষা বানাতে কাজ করছে? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে যখন এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ, তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করছে ইংলিশ সাইনবোর্ড। অথচ বিশ^ব্যাপী বাংলা ভাষার প্রতি, বাংলা ভাষা আন্দোলনে শাহাদাতবরণকারী ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, বাংলা ভাষাকে আলোকিত করতে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। এই ইতিহাস বাংলাদেশের অনেকেরই জানা। কিন্তু এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে রয়েছে আরও অনেক সংগ্রামের ইতিহাস।
প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখন্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল আন্দোলনের। আর এই ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হয়। একজন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে বলতে পারি- ১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল তার আগেই আসলে শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক তাদের ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য বইয়ে লিখেছেন, ‘প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ’। এই বইটির বর্ণনা অনুযায়ী দেশভাগের আগেই চল্লিশের দশকের শুরুতেই সাহিত্যিকরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। সেসময় বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বাংলা, উর্দু, আরবি ও ইংরেজি এই চারটি ভাষার পক্ষ-বিপক্ষে নানান মত ছিল।
ভাষা আন্দোলনের আলোকিত মানুষ আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক লিখেছেন, ভাষা আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়।.......এর সূচনা মূল আন্দোলন শুরু হওয়ার কয়েক দশক আগেই এবং বাঙালি মুসলমানের সেকুলার জাতিয়তাবোধ এর পেছনে কাজ করেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত হওয়ার পর উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেসময়কার গুরুত্বপূর্ন 'মিল্লাত' পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, ‘মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না।’ এমন নিরন্তর আলোর কথা-ভালোর কথা নিয়ে এগিয়ে চলতে চলতে বলতে পারি- একুশে ফেব্রুয়ারি আসলেই বাংলা ভাষা সম্প্রসারণের জন্য আমরা নানা কথা বলি। কিন্তু সারা বছর সেই উদ্যোগ আর দেখা যায় না। আমাদের জীবনে আমরা বাংলাকে যে কত অবহেলা করেছি, তার অনেক নজির আপনারা দেখতে পাবেন। দেশে বাংলা ভাষার এমন অবস্থা যে, এখন বিয়ের কার্ডও ইংরেজিতে ছাপানো হয়। দেশের আইনের ভাষা এমন কঠিন করে রাখা হয়েছে এবং বেশিরভাগ বিচারক বিচারের রায় দেন ইংরেজিতে, যা বিচারপ্রার্থীদের জন্য দুর্বোধ্য। আমরা চাই আইনের সকল ক্ষেত্রে সহজ সাবলীল বাংলা ভাষা ব্যবহার, যাতে করে সবাই বুঝতে পারে। গণমাধ্যমে বিশেষ করে কয়েকটি এফএম রেডিওতে বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়। সেগুলো যদি বন্ধ না হয় তাহলে সাধারণ মানুষ কোথা থেকে প্রমিত বাংলা শিখবে? এমন প্রশ্ন রাখলাম বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে।
একই সাথে বলতে চাই- দেশের অফিস-আদালত থেকে শুরু করে আইন-আদালত, এমনকি বিভিন্ন পোস্টার-প্ল্যাকার্ডে বাংলা ভাষার পরিবর্তে বিদেশি ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। অবস্থা এমন যে আজ বাংলা ভাষা নিজভূমে পরবাসীতে পরিণত হয়েছে। যা কোনভাবেই বাংলা ভাষার মত একটি সাহসী-সংগ্রামী ইতিহাস সম্বলিত ভাষার সাথে না ঘটে, সে বিষয়গুলো গভীরভাবে ভাবতে হবে বলে আমি মনে করি। কেননা, এই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে, বাংলা ভাষায় কথা বলার কথা মনে করে ধীরে ধীরে অর্থনীতি ও রাজনীতিও সেই বিতর্কের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদি পত্রিকায় লেখক সাংবাদিক আবদুল হক লিখেছিলেন, ‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি উর্দু-শিক্ষিতই চাকুরীর যোগ্যতা লাভ করবেন, এবং প্রত্যেকটি বাংলা ভাষীই চাকুরীর অনুপযুক্ত হয়ে পড়বেন’।
বাংলাভাষীদের আরও উদ্বেগ ছিল দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখন্ডের মানুষের সাংস্কৃতিক পার্থক্য নিয়ে। শুধু ধর্ম তাদের মধ্যে কতটুক যোগসূত্র স্থাপন করতে পারবে সে নিয়ে ভাবনা ছিল অনেকের। ইতিহাস বলছে- ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন। তখন ভাষা নিয়ে বিতর্ক আবারো জেগে উঠেছিলো। ততদিনে মুসলিম বাঙালীদের আত্ম-অন্বেষণ শুরু হয়ে গিয়েছিলো। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকেট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এই ঘোষণায় পর ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কমিশনের বাঙালী কর্মকর্তারা সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন। পাকিস্তান গঠনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, পরবর্তীতে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে আইন পরিষদের অধিবেশনে বলেছিলেন, ভাষা সম্পর্কিত বিতর্ক শুরু হওয়ার আগেই এসব ছাপা হয়ে গেছে। যদিও তার এই বক্তব্য সবাই গ্রহণ করেনি।
সে সময় বুদ্ধিজীবীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে মাতৃভাষার পরিবর্তে উর্দু চাপিয়ে দিলে বাংলাভাষী পরবর্তী প্রজন্ম অশিক্ষিত হয়ে পড়বে, বাংলা ভাষার সত্ত্বা ঝুঁকিতে পরবে। স্বাধীনভাবে মাতৃভাষার চর্চার ক্ষেত্রে এটিকে বড় আঘাত বলে মনে করা হয়েছে। এসব বিষয়ে বাঙালির মনে ক্ষোভের অনুভূতি তখন থেকেই দানা বাঁধতে থাকে। সেই সালেই শেষের দিকে 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করা হয়। সে সময়কার তমদ্দুন মজলিসের নূরুল হক ভূঁইয়া, তৎকালীন সংসদ সদস্য সামসুল হক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠাতা অলি আহাদ, পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ তোয়াহা সহ অনেকেই এর সদস্য ছিলেন যারা শুরুতে গোপনে কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাভাষীরা উর্দুভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারপরও ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’। সেই সমাবেশেই উপস্থিত অনেকেই সাথে সাথে প্রতিবাদ করে ওঠেন। এই ঘোষণাকে বলা যেতে পারে নতুন রাষ্ট্র সম্পর্কে বাঙালীর স্বপ্নভঙ্গের সূচনা। জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে শুরু থেকে অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
১৯৫২ সালের সেই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কর্মরত ছিলেন মুহাম্মদ মাহফুজ হোসেন। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পেছনে বাঙালীদের উপর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভুত্ব কায়েম করা ও শোষণের অভিসন্ধি বলে মনে করা হয়েছিল। বাঙালীদের মনে পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বাসের ভীত তৈরি হয়েছিল। ভাষা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য আরও জোরালোভাবে প্রতীয়মান হচ্ছিল। ধর্ম নয় বরং বাঙালী জাতিয়তাবাদের ধারনা স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে তখনকার উর্দুভাষীরা বাঙালীর সংস্কৃতিকে 'হিন্দুয়ানী' বলে মনে করাটা বাংলা ভাষার প্রতি তাদের বিতৃষ্ণার আরেকটি কারণ। জিন্নাহ'র মৃত্যুর পরও রাষ্ট্রভাষা নিয়ে নানা রকম প্রস্তাব, পাল্টা প্রস্তাব চলতে থাকে। দেশভাগের পর থেকে ১৯৫২ সালের শুরু পর্যন্ত বাঙালীরা জোরালোভাবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধ মনোভাব ব্যক্ত করে গেছেন।
প্রতিক্রিয়া হিসেবে থেমে থেমে আন্দোলন চলেছে। তবে এই আন্দোলনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অগ্নি স্ফুলিঙ্গের জন্ম হয় যখন বায়ান্নর ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। পূর্ব-বঙ্গের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহ'র কথাই পুনরাবৃত্তি করেন। সেসময়ও একইভাবে জোরালো প্রতিবাদে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগান ওঠে। অবশ্য বলা হয়ে থাকে রাজনৈতিক কারণে নেয়া খাজা নাজিমুদ্দিনের অবস্থান ও তার বক্তব্য ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। তার ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে বঞ্চনার অনুভূতি আরও জোরালো হয়ে জেগে ওঠে।
খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে পরদিন থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল। যাতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ভাসানীর নেতৃত্বে সম্মেলনে অংশ নেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সংস্কৃতিকর্মী এবং পেশাজীবী সম্প্রদায়ের মানুষজন। ২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়েছিল। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিলো। যা লঙ্ঘন করেই জন্ম হয়েছিল শহীদ দিবসের। ১৯৫২ সালের সেই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কর্মরত ছিলেন মুহাম্মদ মাহফুজ হোসেন। বছর তিনেক আগে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাতকারে তার বর্ণনায় ফুটে উঠেছে সেদিনকার চিত্র। সেই সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, "একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে হাসপাতালে গ্রহণ করি আমি। কপালে গুলিবিদ্ধ রফিককে দেখেই মৃত ঘোষণা করা হয়, আর উরুতে গুলিবিদ্ধ বরকত মারা যান রাতে, আমার চোখের সামনেই।" ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছেই গুলিবর্ষণ হয়েছিল শিক্ষার্থীদের উপর। তিনি বলছিলেন, "আমরা তখন বাইরে থেকে বহু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমরা শুনেছিলাম বহু মানুষ গুলিতে আহত হয়েছে। মুহূর্তেই ইমারজেন্সি ওয়ার্ড পূর্ণ হয়ে যায়। আহতদের অনেকেই মুমূর্ষু, তাদের সঙ্গে আসা মানুষজন আর চিকিৎসকে ঠাসাঠাসি হয়ে যায় জরুরী বিভাগ।"
ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিলেন সেবিষয়ে সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায় না। সেদিন এবং পরদিন পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং শফিউর ছাড়াও আরো অনেকে শহীদ হয়েছিলেন বলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে। এই হত্যাকান্ড মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়নি। এই আন্দোলনেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখন্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মনে এক হওয়ার অনুভূতি সম্ভবত জাগ্রত হবে না। তবে এই ঘটনার পরও দুই বছরের বেশি সময় পরে, ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান সংসদ বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করে।
শুধু বৈদেশিক যোগাযোগ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ সব ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ডে বাংলা ভাষার ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করার দাবি এমন নতুন প্রজন্মের প্রতিটি প্রতিনিধির। আর এ কারণেই প্রতিবাদে-প্রতিরোধে আন্দোলনে সংগ্রামে সাহসের সাথে বলছি, চলছি-সাহসের সাথে। সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু আমাদের সুপ্রিম কোর্ট, যার দায়িত্ব হচ্ছে কোথায় সংবিধান ভঙ্গ হচ্ছে কি না তার দেখভাল করা, কোথাও সংবিধান নিয়ে কোনো বিতর্ক হলে তারা ব্যাখ্যা প্রদান করা। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করেছি, আমাদের মহামান্য আদালত সংবিধান লংঘন করে বিদেশি ভাষায় রায় প্রদান করে, বিচারকার্য পরিচালনা করে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এর মূল তাৎপর্য হল, বাঙালি যেভাবে তাদের মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগ করেছে, তোমরাও তোমাদের মাতৃভাষাকে লালন কর, পালন কর, সমুন্নত রাখ। অথচ আজকে বাংলা ভাষা যেন নিজ ভূমিতে পরবাসী। বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে সরকারকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে, এর অন্য কোনো বিকল্প নেই।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জীবনে এক অসীম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। যা আমাদের সার্বিক জাগরণের উৎসমুখর। একুশের চেতনা কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও পরোক্ষভাবে অনুপ্রেরণার সঞ্চারী হিসেবে অন্তরে অনির্বাণ শিখা হয়ে জ্বলে। একুশের চেতনা বারবার সংকটে দিক নির্দেশক, বিভ্রান্তিতে মোহজাল ছিন্নকারী এবং আপাত বন্ধ্যত্বে সৃষ্টিমুখরতার দ্যোতক বলে প্রমাণিত হয়েছে। আর তাই বায়ান্ন থেকে একাত্তর যেমন বুকের ভেতর বাঁশি বাজায় সাহসের-সংগ্রামের; সেই বাঁশির সূত্রতায় বলতে চাই- প্রতিটি পর্বে বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার আর সম্মান প্রদর্শনে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ প্রয়োজন নিরন্তর...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি