আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হলো ২১ ফেব্রুয়ারী। নিজ মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য বাঙালিদের প্রাণ উৎসর্গের এ দিবসটিই এখন শুধু বাঙালিদের নয়, গোটা বিশ্বের। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হলেও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণে তেমন কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায় নি। মাতৃভাষার জন্য যে বাঙালিরা প্রাণ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রাম রচনা করেছে সেই বাংলাদেশেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আজ তাদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি হারাতে বসেছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বলছে, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তাদের বাংলাদেশের নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় সমতলে ও পাহাড়ে পাওয়া ৪১টি ভাষার মধ্যে ১৪টি বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিপন্ন ভাষার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের রেংমিটচ্য ভাষা, সমতলের পাত্র জনগোষ্ঠীর লালেং ভাষা খুবই সংকটনাপন্ন।
রেংমিটচ্য ভাষা জানা ছজন পার্বত্য চট্টগ্রামে আছেন। তারা সবাই বয়সে ষাটোর্ধ্ব। থাকেন পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে। ফলে তাদের মধ্যে ও এ ভাষা বলার কোনো প্রচলন নেই। তারা জীবিকার তাগিদে ¤্রাে জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যাওয়ায় তারা তাদের মাতৃভাষার চর্চা করতে পারছেন না। সংগতঃ কারণে বলা যায়, এ ছ'জন মারা গেলে রেংমিটচ্য ভাষাও হারিয়ে যাবে। হয়তো ভাষার গবেষকদের লিখায় তাদের ভাষার কথা জানা যাবে। কিন্তু সে ভাষা শোনা যাবে না। এ ভাষা একদিনে বিপন্ন হয় নি। শত বছরের পরিক্রমায় তা হয়েছে। তবে আশির দশকে সবচেয়ে সংকটে পড়ে৷ সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত পরিস্থিতির জন্য রেংমিটচ্য ভাষার ¤্রােরা অধিকাংশই মিয়ানমার ও ভারতের উত্তর পূর্বাচলের গহিন বনাঞ্চলে চলে যায়। তখন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় যারা চলে গেছেন তারাও অন্য ভাষাভাষীর সাথে মিশে নিজেদের ভাষা হারিয়েছেন।
প্রাচীন ইয়াগান জনগোষ্ঠীর ইয়ামানা ভাষার শেষ প্রদীপটিও নিভে গেল। দক্ষিন আমেরিকার দক্ষিনে খুব দূর্গম এলাকায় বসবাসকারী ক্রিস্টিবা কালদেরন (৯৩) গত ১৭ ফেব্রুয়ারী মৃত্যুর সাথে সাথে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল ইয়াগান জনগোষ্ঠীর ইয়ামানা ভাষা। বংশপরম্পরায় পাওয়া নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি বুকে ধারণ করা এ ব্যক্তিটি তার মাতৃভাষা বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করেছেন, লিখার চেষ্টা করেছেন ইয়ামানা ভাষার অভিধান। অভিধানটি স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করার মাধ্যমে তার ওই ভাষাজ্ঞান সংরক্ষণের কাজ করেন। ইয়াগান ভাষা জানা আর কেউ বিশ্বে বেঁচে আছে কিনা, তা জানা যায় নি। তবে তাদের কয়েক প্রজন্ম তাদের মাতৃভাষা শেখা বন্ধ করে দেয় নিজেদের বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী মনে করে। মূলতঃ তাদের উৎস খুঁজে পেতে অসুবিধার কারণে তারা তাদের মাতৃভাষা বিমুখ হয়ে পড়ে।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বলছে, প্রতি দুই সপ্তাহে বিশ্বের বুক থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে একটি করে ভাষা। তার সাথে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। ভাষার আগ্রাসানের কারণে বৈচিত্রময় বিশ্বের বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত নানা প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা। বিলুপ্তির হাত থেকে ভাষাগুলোকে রক্ষায় ও বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পালন করা হয়। কাজেই শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, কার্যকরভাবে ভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। এজন্য বিলুপ্ত প্রায় ভাষাভাষীদের উদ্যোগও প্রয়োজন।