খননকৃত মাটি ও বালু রাখার জায়গা সংকটের কারণে বঙ্গবন্ধু মোংলা-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ ক্যানেলের খনন কাজ ব্যহত হচ্ছে। একদিকে মাটি ফেলার জমির অভাব অন্যদিকে অতিরিক্ত স্রােত ও যান চলাচলের কারণে দিনে সক্ষমতা ১৩ ঘন্টা থাকা স্বত্তেও মাত্র ৫ থেকে ৬ ঘন্টা চলছে খনন কাজ। অনেক ক্ষেত্রে ডাইক ভেঙ্গে খননকৃত মাটি আবারও নদীর মধ্যে চলে আসছে। খননকৃত বালু-মাটি মাটি না সরালে এবং নতুন জমির ব্যবস্থা না হলে যেকোন সময় খনন কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে বিরুপ প্রভাব পড়বে মোংলা বন্দরে জাহাজ আগমন ও নির্গমনে। যার প্রভাব পড়বে মোংলা বন্দর ও এ অঞ্চলের অর্থনীতির উপর। পাশাপাশি নাব্যতা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক এই নৌরুটটির। বালুমাটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া এবং ব্যক্তিমালিকানা জমি অধিগ্রহন করে খনন কাজে গতি ফেরানোর দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বিআইডব্লিউটিএ-র ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবদুল মতিন।
বাংলাদেশে অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানাযায়, বঙ্গবন্ধু মোংলা-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ ক্যানেলটির দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটার। নাব্যতা সংকটে ২০১০ সালে এই চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়। বিকল্প চ্যানেল হিসেবে সুন্দরবনের শ্যালা নদী থেকে নৌযান চলাচল শুরু হয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডোবায়। তখন আবারও মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলকে নতুনভাবে চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে তখন থেকে আবারও মোংলা ঘষিয়াখালী চ্যানেল ড্রেজিং শুরু হয়। ২০১৫ সালের শেষে দিকে আবারও এই চ্যানেল থেকে নৌযান চলাচল শুরু হয়। এরপর থেকে এই চ্যানেলকে সচল রাখতে নিয়মিত উন্নয়ন ও সংরক্ষন খনন কাজ চলে আসছে। এখন পর্যন্ত এই চ্যানেল থেকে ৩ কোটি ৩৮ লক্ষ ৯৭ হাজার ঘনমিটার (এক ঘন মিটার সমান ৩৫ দশমিক ৩১ ঘনফুট) বালুমাটি খনন করা হয়েছে। বর্তমানে ২০২১-২২ অর্থ বছরে এই চ্যানেল খননের জন্য ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান খুলণা শিপইয়ার্ড চারটি ড্রেজার প্রতিদিন এই চ্যানেলে খনন কাজ করছে। কিন্তু নদীতে ভাটার সময় অতিরিক্ত স্রােত, নৌযান চলাচল ও মাটি রাখার জায়গার অভাবে খন কাজ ব্যহত হচ্ছে।
সরেজমিনে মোংলা-ঘষিয়াখালি চ্যানেলের বুড়িরডাঙ্গা সংলগ্ন এলাকায় দেখা যায়, খননকৃত মাটি ফেলার কারণে ক্যানেলের দুই পাশে মাটির উঁচু স্তুপ তৈরি হয়েছে। মাঝে মাঝে এই স্তুপের ডাইক ভেঙ্গে খননকৃত বালু-মাটি কখনো নদীর মধ্যে ও কখনো’বা গ্রামের মধ্যে পড়ে। ফলে স্থানীয় বসবাসকারীদের নানান সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পাশাপাশি ঝড়-বাতাসে কাদামাটি ও বালু ঢুকে স্থানীয় অনেক রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দূর্ভোগে পড়তে হয় স্থানীয়দের। তাই জনবসতিপূর্ণ এলাকা বাদ রেখে জমি অধিগ্রহণ করে খননকৃত মাটি ফেলার দাবী স্থানীয়দের।
বুড়িরডাঙ্গা গ্রামের তানিয়া বেগম বলেন, সারা বছর ধরে এখানে নদী খনন চলে। খনন করে উত্তোলিত বালু আমাদের ঘরবাড়ির পাশেই রাখা হয়। কিছু দিন আগে টানা বৃষ্টিতে বালু আটকে রাখার বাঁধ ভেংগে গ্রামের মধ্যে বালু ঢুকে বালুতে ঘের-বাড়ি সব তলিয়ে যায়। জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তারা শুধু দেখে যায় আর আশ্বাস দেয় কিন্তু আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয় না। আমরা চাই এই বালু যেন অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে আমাদের ভোগান্তি দূর করা হয়।
পাকখালি এলাকার জামাল মৃধা বলেন, খননকৃত মাটি অনেক বড় ডাইকে রাখে। কিন্তু ডাইকের বাঁধগুলো খুবই ভঙ্গুর হওয়ায় মাঝে মাঝেই নদীতে চলে যায় ডাইকের বালু। এর থেকে নদীর দুই পাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় অধিগ্রহন করে বালু রাখলে আর এই ঝামেলায় পড়তে হত না।
তিনি আরো বলেন, নদী খননের স্তুপ করা বালিতে আমাদের ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখানে থাকতে খুব কষ্ট হয়। কোনো সাহায্যেও পাই না আমরা।
ওবায়দুল সর্দার নামের একজন বলেন, বালু-মাটি আটকে রাখার জন্য আমাদের এখানে একটা বেড়িবাঁধ করে দিছে। কিন্তু এই বাঁধ আগেও একাধিকবার ভেংগে গেছে। প্রতিবার ভাংয়ে আর আমাদের বিপদ বাড়ে। আমরা চাই টেকসই ভাবে বাঁধটি নির্মাণ করে যেন আমাদের ভোগান্তি দূর করা হয়।
এম ভি সোনালী আঁশ নামের একটি কার্গো জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ শেখ ফরিদ বলেন, ড্রেজিং চলমান থাকায় আমাদের খুব সুবিধা হচ্ছে। নদীতে পলি বসতে পারছে না। কিন্তু খনন কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই আমরা চাই খনন কাজ যেন অব্যহত থাকে।
ড্রেজিং প্রতিষ্ঠানের সাইট ইঞ্জিনিয়ার গোপীনাথ দাস বলেন, প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা ড্রেজার চালানোর সক্ষমতা রয়েছে আমাদের। কিন্তু স্রােত বেশি থাকায় এবং প্রতিনিয়ত বড় ধরনের নৌযান চলাচলের কারণে ৫-৬ ঘন্টার বেশি ড্রেজিং সম্ভব হয় না। তারপরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
বিআইডব্লিউটিএ, ড্রেজিং বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পুর), মোঃ আনিছুজ্জামান বলেন,মোংলা ঘোষিয়াখালী চ্যানেলটির ড্রেজিং কার্যক্রম অব্যহত রাখতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত সিলটেশন এর কারণে প্রতিনিয়ত চ্যানেল ভরাট হচ্ছে। ৫-৬ বছর ধরে আমরা ড্রেজিং করছি। ফলে নদীর আশপাশে আর কোনো খালি জায়গা নেই। এ ছাড়া রাস্তাঘাট না থাকায় ইচ্ছে করলেই যানবাহনের মাধ্যমে মাটি অন্যত্র নেওয়া যাচ্ছে না। এরপরেও আমরা দুই-তিনটা ডাইকের মাটি সরিয়েছি। এতে সাময়িক ভাবে ড্রেজিং কার্যক্রম অব্যহত রাখা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দ্রুত-ই বৃহত পরিকল্পনা প্রয়োজন। অন্যথায় ড্রেজিং করা আরও বেশি চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে বলে জানান এই প্রকৌশলী।
মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব এম এ সবুর রানা বলেন, সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে চ্যানেলটি ড্রেজিং করছে। চ্যানেলটি সুন্দরবন ও আশপাশ এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খনন কাজ যেন বাধাগ্রস্থ না হয় সেজন্য সরকারের জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ খনন বন্ধ হয়ে গেলে এই চ্যানেলও বন্ধ হয়ে যাবে। চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেলে মানুষের জীবন জীবিকার উপর নেতবাচক প্রভাব পড়বে। এজন্য যেকোন মূল্যে জমি অধিগ্রহন করে খনন কাজ অব্যাহত রাখার দাবি জানান তিনি।
বিআইডব্লিউটিএ-র ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল মতিন বলেন, দীর্ঘদিন খননকৃত মাটি ফেলার ফলে ক্যানেলের দুইপাশের খাসজমি বেশিরভাগ ভরাট হয়ে গেছে। অবশিষ্ট যে খাস জমি রয়েছে তাও কিছুদিনের মধ্যে ভরে যাবে। তখন ড্রেজিং কাজ চালু রাখার জন্য জমি অধিগ্রহণ ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। এজন্য আমাদের পরিকল্পান রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে সারাবছরই ড্রেজিং কাজ চালিয়ে রাখা যায়।