করোনার সময় আমাদের দেশসহ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হয়েছিল, তখন দেশে ব্যাংকে আমানত প্রবাহ বেড়েছিল। এটা এক প্যারাডক্স বটে, করোনার প্রকোপ কমার ফলে দেশ-বিদেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু হওয়ায় ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি আগের তুলনায় বাড়ার কথা থাকলেও তা না বেড়ে কমতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যা ৫১ হাজার ৪৬৬ কোটি। অথচ গত বছরের একই সময়ে আমানত প্রবাহ বেড়েছিল ৫১ শতাংশের বেশি। বলতেই হবে, আমানত প্রবৃদ্ধির হার বাড়া বা কমার এই গতি অস্বাভাবিক। দেশের অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরাও বলছেন একই কথা। তারা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বাড়লে মানুষের আয় বাড়ে, আয়ের একটি অংশ তারা সঞ্চয় করে, ফলে ব্যাংকে আমানত প্রবাহও বাড়ে। কিন্তু ঘটছে উলটোটা। আমানত প্রবাহ না বেড়ে বরং কমছে। যে সময়ে আমানত কমার কথা, তখন বেড়েছে; এখন বাড়ার কথা কিন্তু কমছে। এটা অস্বাভাবিক ঘটনা। আমাদেরও প্রশ্ন, গ্রাহকদের টাকা তাহলে যাচ্ছে কোথায়? এই টাকা প্রাতিষ্ঠানিক খাতে বিনিয়োগ হলে তা ঘুরেফিরে ব্যাংকেই আসত, কিন্তু আসছে না। এর মানে এই টাকা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে চলে যাচ্ছে। তবে কি টাকাগুলো হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে? বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি কমার কারণ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক ধরনের যুক্তি দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষকরা বলছেন, ২০২০ সালে মানুষের চলাচল কম ছিল, টাকার সঞ্চালনও ছিল স্তিমিত; ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল স্থবিরতা। ফলে গ্রাহকরা ব্যাংকেই টাকা গচ্ছিত রেখেছিল। করোনার প্রভাব কমায় মানুষের চলাচল বেড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এ সময় বিনিয়োগ বেড়েছে। এ কারণে ব্যাংক থেকে টাকা বের হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া মুনাফার হার কম হওয়ায় মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে বিভিন্ন জায়গায় লগ্নি করছে। এসব কারণে আমানত প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ব্যাখ্যা কতটা গ্রহণযোগ্য, তা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। কারণ এই ব্যাখ্যায় টাকা পাচারের বিষয়টি অনুপস্থিত। অনেকেই মনে করেন, করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার পরও যখন ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি না বেড়ে বরং কমেছে, তখন এর পেছনের অন্যান্য কারণের মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের বিষয়টিও রয়েছে। ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে তা ব্যাংকিং খাতে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর যেমনটা বলেছেন- আমানত হচ্ছে ব্যাংকের রক্ত সঞ্চালনের মতো। দীর্ঘ সময় ধরে আমানত কমতে থাকলে ব্যাংকগুলোয় তারল্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হতে হবে। আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে যে কী পরিস্থিতি তৈরি হয়, তা কয়েক দফায় দেশের ব্যাংক খাত অনুভব করেছে। তার এ কথার সূত্র ধরে বলতে হবে, ব্যাংক খাতের এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। টাকা কোথায় যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখাসহ ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টা নিতে হবে।