বিভাগীয় শহর বরিশালের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সব কর্মসূচি পালন করা হয় নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোডে অবস্থিত অশ্বিনী কুমার টাউন হলের মিলনায়তনকে ঘিরে।
দীর্ঘদিন বন্ধ এবং অযতœ অবহেলার স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে পরে আছে নগরীর ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বাক্ষী অশ্বিনী কুমার টাউন হল ভবন। যার সংস্কার করাও এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পরেছে বলে দাবী করেছেন সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দরা। তারপরেও বারবার চলছে সংস্কার।
সচেতন নগরবাসীর মতে, টাউন হলটির মূল ডিজাইন অক্ষুন্ন রেখেই পিলার ও পাটাতন লোহা দিয়ে গড়া সম্ভব। করোনাকালীন সংকটে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মকা- সীমিত হয়ে পরায় থেমে গেছে এই হলটির প্রাণচাঞ্চল্য। দূর থেকে এখানে আগের মতো চাকচিক্য বা উৎসবমুখরতা চোখে পরেনা। গত কয়েকদিন থেকে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে সংস্কার কাজ চলছে টাউন হলের ভিতরে।
বরিশাল নগররি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সমাবেশের প্রাণকেন্দ্র এই অশ্বিনী কুমার টাউন হল মিলনায়তন। এখনও বিভিন্ন রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সভা সেমিনার, মানববন্ধন কর্মসূচি এই হলকে ঘিরেই পরিচালিত হচ্ছে।
জেলা বাসদ’র সদস্য সচিব ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী বলেন, বরিশালের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সব কর্মকা- ও সিদ্ধান্ত টাউন হল মিলনায়তনকে ঘিরে। তিনি আরও বলেন, ১৯৩০ সালে অশ্বিনী কুমার টাউন হল নির্মাণ করা হয়। টাউন হল নির্মিত হওয়ার পূর্বে বরিশালের সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো রাজা বাহাদুরের হাবেলিতে।
সিরাজ উদ্দীন আহমেদের বরিশাল বিভাগের ইতিহাস গ্রন্থ ও উইকিপিডিয়া ঘেঁটে পাওয়া গেছে অশ্বিনী কুমার টাউন হল নির্মাণের ঘটনাবহুল রহস্য। এই টাউন হলের ট্রাস্ট দলিলের চৌহদ্দির যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে রাজা বাহাদুর হাবেলি ছিলো এর পূর্ব দিকে বর্তমান কাঠপট্টি রোডের দক্ষিণে এবং চক বাজার রোডের পশ্চিমে অবস্থিত। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজা বাহাদুরের হাবেলিতে মিছিলের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। ওই ঘটনা থেকে বরিশালবাসীর নিকট অনুভূত হয় বরিশালের সভা-সমাবেশের জন্য একটি টাউন হল নির্মাণ প্রয়োজন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে অশ্বিনী কুমার দত্তকে সভাপতি ও শরৎ চন্দ্র গুহকে সম্পাদক করে টাউন হল নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠণ করা হয়।
ওই কমিটির উদ্যোগে ১৯২০ সালে টাউন হলের জন্য জমি ক্রয় করা হয়। টাউন হলের ট্রাস্টি দলিলের তথ্যানুযায়ী বাংলা ১৩২৭ সালের ২৮ আশ্বিন মোতাবেক ইংরেজি ১৯২০ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখে ওই জমি খরিদ করা হয়। ট্রাস্টি দলিলে লিখিত রয়েছে, আমরা অনেক পরিশ্রম করিয়া এবং নিজ হইতে যথাসাধ্য চাঁদা দিয়া এবং সর্বসাধারণ হইতে চাঁদা সংগ্রহ করিয়া বরিশালের সর্বসাধারণের উপকারার্থে সভা-সমিতির অধিবেশন, নির্দোষ আমোদ ও প্রমোদ অনুষ্ঠান এবং জনহিতকর কার্যের জন্য একটি টাউন হল স্থাপনার উদ্দেশ্যে নিন্মের (ক) তফসিলে লিখিত ভূমি মং ৪০০০/- (চার হাজার) টাকা মূল্যে শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মহাশয়ের নিকট হইতে ১৩২৭ সালের ২৮ আশ্বিন তারিখে সম্পাদিত রেজিস্ট্রিকৃত কবলামূলে শ্রীযুক্ত হরনাথ ঘোষ, অশ্বিনী কুমার দত্ত, তারিণী কুমার গুপ্ত এবং একে ফজলুল হক (শেরেবাংলা) সাহেবের নামে খরিদ করিয়া পাকা টাউন হল নির্মাণ করিতেছি।
ট্রাস্ট দলিলের তথ্য অনুযায়ী, অশ্বিনী কুমার টাউন হলের ট্রাস্টি ছিলেন ৫৩ জন। তন্মধ্যে কয়েকজন হলেন সরল কুমার দত্ত, ভূপেন্দ্রনাথ সেন, দিলীপ কুমার রায়, যোগেন্দ্রনাথ সেন, মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী, দক্ষিণারঞ্জন রায় চৌধুরী, রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী, জ্ঞানেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী, মুহাম্মদ ইসমাইল খান, নওয়াবজাদা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, মৌলভী আবুল কাসেম ফজলুল হক, ফকরউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ।
সূত্রমতে, অশ্বিনী কুমার টাউন হলে যেকোনো ধরনের খুশি অনুষ্ঠান করা যায়। কিন্তু নির্মানের সময় তা যেতো না। ওইসময় এর ট্রাস্ট দলিলে লিখিত ছিলো, নির্দোষ আমোদ ও প্রমোদ অনুষ্ঠান। এ শব্দটিকে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হতো। সূত্রে আরও জানা গেছে, এখানে সিনেমা দেখানো আরম্ভ হলে তার প্রতিবাদ করে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা শরৎ কুমার ঘোষ অনশন পর্যন্ত পালন করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে বিশেষ করে ষাটের দশকে নির্লজ্জভাবে এই টাউন হলটি আইয়ুব খানের নামে নামকরণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৬২ সালে হলটির নাম আইউব খান টাউন হল এবং গেট দুটিতে যথাক্রমে মিল্লাত ও কায়েদে আজম নাম লিখে তৎকালীন বিহারী জেলা প্রশাসক সাইনর্বোড টানিয়ে দিয়েছিলেন। তখন স্থানীয়রা আন্দোলন করে ওই সাইনবোর্ড ভেঙ্গে দিয়েছেন।
জনতার রোষের সামনে তা করতে না পেরে সরকারী ভাবে এর নাম বলা হচ্ছিলো এ.কে হল। যা দিয়ে বোঝানো হতো আইয়ুব খান হল। কিন্তু স্থানীয়দের তোপের মুখে পরলে তৎকালীন সরকারী কর্মকর্তারা বলতেন এ.কে হল মানে অশ্বিনী কুমার। ২০১২ সালে সরাসরি একটি গণমাধ্যমের কাছে সাক্ষাতকারে প্রয়াত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিখিল সেন বলেছিলেন, এ.কে নিয়েও বিতর্ক উঠেছিলো। শেরেবাংলা তখন কলকাতার মেয়র ছিলেন। তিনি মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের খুব স্নেহভাজন ছিলেন। তখন স্বয়ং শেরেবাংলা ফজলুল হক অশ্বিনী কুমার টাউন হল নামকরণে গুরুত্বারোপ করেন।
সচেতন নাগরিক কমিটির জেলা সভাপতি শাহ সাজেদা বলেন, অশ্বিনী কুমার টাউন হল বরিশালবাসীর এক জাগ্রত চেতনার প্রতীক। ব্রজমোহন বা বিএম কলেজের রাজনীতিরও চেতনার কেন্দ্র ছিলো এই টাউন হলটি। যা গত প্রায় ১০০ বছর ধরে একইরকম অবস্থায় রয়েছে। বেশ কয়েক বার সংস্কার করা হলেও ভবনের মুল ভিত্তি ঠিক রাখা হয়েছে।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সাংস্কৃতিক সমন্বয় পরিষদের নেতৃবৃন্দরা বলেন, মেয়র টাউন হলটির সংস্কার করে আধুনিক করার দায়িত্ব নিয়েছেন। ভিতরে যতোটা আধুনিকায়ন করা যায় তা তিনি (মেয়র) করবেন বলে জানিয়েছেন। বর্তমানে সংস্কার কাজ চলছে। তবে এ ভবনটি এখন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সংস্কার করাও কঠিন হয়ে পরেছে।