এমনিতেই গ্রামের চায়ের দোকানগুলোকে গ্রামীণজনগোষ্ঠীর আলোচনার হোয়াইট হাউজ বলা হয়ে থাকে। সেইসব চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিস কিংবা আদালত পাড়ায় গত নয়দিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে ঘিরে।
বরিশাল জেলার দশটি উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামের চায়ের দোকানগুলোতে সকাল থেকে শুরু হয়ে যুদ্ধের এ আলোচনা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। চায়ের কাপে চুমুকের সাথে কখনও দোকানগুলোতে প্রদর্শন করা টেলিভিশনের খবর দেখে, আবার কখনও ডিজিটাল বাংলাদেশের বদৌলতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজ দেখে চলে আলোচনা। চায়ের দোকানের এসব আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন গ্রামের খেটে খাওয়া দিনমজুর থেকে শুরু করে সকল বয়সের মানুষ। চায়ের দোকানের এ আলোচনা বর্তমানে অফিস-আদালতসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পরেছে।
বিশেষ করে ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে নোঙর করে থাকা বাংলাদেশের জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে রকেট হামলায় বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার কদমতলা গ্রামের বাসিন্দা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের নিহতের সংবাদ গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পরার পর বরিশালের গ্রামীণজনপদে আলোচনা আরো জোরদার হয়েছে।
যুদ্ধ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকার কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন না করলেও চায়ের দোকানের এসব আলোচকরা কেউ রাশিয়া আবার কেউ ইউক্রেনকে সমর্থন করছেন। সবমিলিয়ে সচেতন নাগরিকরা যুদ্ধ বন্ধের মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বিশ্ব নেতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
গত দুইদিন থেকে বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধকে ঘিরে ইতোমধ্যে বরিশালের কতিপয় অধিক মুনাফালোভী পাইকারী ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্যের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বাজারে প্রতিটি পন্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছেন। এরমধ্যে তেলের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি করা হয়। দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রনে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্য কোন তদারকি না থাকায় খোড়া অজুহাতে ব্যবসায়ীরা বাজারে প্রতিটি পন্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছে।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শেনেরহাট নামক বাজারে ইমাম হোসেনের চায়ের দোকানে দেখা গেছে, টেলিভিশনে যুদ্ধের সংবাদ দেখছেন গ্রামের বিভিন্ন বয়সের ৮/১০জন মানুষ। সংবাদ শেষে যুদ্ধ নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষন করতে করতে ওই দোকানে চায়ের কাপে ঝড় তুলেছেন গ্রামের ওইসব মানুষগুলো।
এগিয়ে গিয়ে শোনা গেল, গ্রামের ওইসব আলোচকদের মধ্যে কেউ বলছেন, কিছু বিদেশী নেতা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইউক্রেনকে উস্কানি দিচ্ছে। কেউ আবার বলছেন, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার অধিকার আছে। সেখানে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর আধিপত্যবাদ টিকিয়ে রাখার কোন যুক্তি নেই। যাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ বলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট একজন জাতিগত ইহুদি। তাই তিনি তার প্রতিবেশী রাশিয়াকে বাদ দিয়ে ন্যাটোর সাথে হাত মেলানোর কারণেই আজ যুদ্ধ হচ্ছে। সত্তর বয়সের আরেক বৃদ্ধ বলেন, যুদ্ধ কোনদিন দেশের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারেনা। আজ যারা ওই যুদ্ধে মারা যাচ্ছে তাদের পরিবার ছাড়া এ কষ্ট আর কেউ বুঝবেন না। যেমনটা বুঝতে শুরু করেছেন আমাদের বরিশালের সন্তান হাদিসুরের পরিবার।
কলেজ পড়-য়া এক ছাত্র বলেন, ইউক্রেন কিংবা রাশিয়া বুঝিনা, সবার আগে বুঝি আমার সবাই মানুষ। আর তাই যেকোন যুদ্ধ কিংবা সংঘাতে কারো জীবনের ক্ষতি হোক তা আমাদের কাম্য নয়। তিনি আরও বলেন, এমনিতেই করোনা মহামারীর ধকল কাটিয়ে বিশ্বের কোন দেশ এখন পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেননি। এছাড়াও বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বাংলাদেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা রয়েছেন। যুদ্ধের কারণে আমাদের সেইসব রেমিট্যান্স যোদ্ধারাও এখন জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। তাই পরম সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধাসহ বিশ্ববাসীকে হেফাজতে রাখেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে পুঁজি করে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার ন্যায় বরিশালের অধিক মুনাফালোভী কতিপয় পাইকারী ব্যবসায়ী দ্রব্যমূল্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এরমধ্যে অধিকাংশ বাজার থেকে তেল উধাও হয়ে গেছে। গত নয়দিন ধরে বাজারের প্রতিটি দ্রব্যমূল্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পরেছেন খেঁটে খাওয়া দিনমজুর পরিবারগুলো।
অভিযোগ রয়েছে, দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রনে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্য কোন তদারকি না থাকায় যুদ্ধের খোড়া অজুহাতে ব্যবসায়ীরা বাজারে প্রতিটি পন্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়েছে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা। এরমধ্যে বুধবার দিবাগত রাতে জেলার উজিরপুর উপজেলার বামরাইল ইউনিয়নের আটিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ওসি মৃত সহিদুল ইসলাম সরদারের গৃহের কলাপসিবল গেটের তালা ভেঙ্গে দুর্র্ধর্ষ ডাকাতি সংঘঠিত হয়েছে। ওই পরিবারের সদস্যদের হাত, পা বেঁধে ডাকাতদল নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান মালামাল লুট করে নিয়েছে। আগৈলঝাড়া উপজেলায় এক চালককে অচেতন করে তার ইজিবাইক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
হাদিসুর ছিলো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ॥ ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে নোঙর করে থাকা বাংলাদেশের জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে রকেট হামলায় নিহত মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান ছিলো তার অসহায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগের বরগুনার বেতাগী উপজেলার কদমতলা গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাকের চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে হাদিসুর সবার বড়। ২০১৩ সালে মেরিন একাডেমি থেকে প্রকৌশলী হয়ে বের হয়ে চাকরিতে যোগদান করেন হাদিসুর। তার বাবা আবদুর রাজ্জাক স্থানীয় একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। ২০১৫ সালে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। সামান্য বেতনের চাকরি। এরমধ্যে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে গিয়ে তিনি তার সব জমিজমা বন্ধক রেখেছেন। কিছু জমি বিক্রিও করতে হয়েছে। সবশেষ পরিবারের একমাত্র সম্বল বলতে ছিলো, বড় ছেলে হাদিসুরের চাকরি ও পুরনো কাঠের ঘর। ইউক্রেন ও রাশিয়ার চলমান যুদ্ধে রকেট হামলায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মৃত্যুর পর তার পুরো পরিবারের ভবিষ্যত এখন ঘোর অন্ধকারে হাবুডাবু খাচ্ছে।