দেশের পাহাড়ি অঞ্চলের উদ্যোক্তা চাষীদের অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে নৌপথ খননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় প্রতি বছর অন্তত ১৯ লাখ টন ফলের আবাদ হয়। আর ওই উৎপাদন বার্ষিক ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় পাহাড়ের চাষীরা ওসব ফল বাজারজাত করা নিয়ে অনেক সময় সঙ্কটে পড়ে। পাহাড়ি ওসব ফল ও অন্যান্য পণ্য বাজারজাত করা এবং নৌপথে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে সরকার ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে সাঙ্গু, মাতামুহুরী নদী ও রাঙ্গামাটি-থেগামুখ নৌপথ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সম্প্রতি সাঙ্গু, মাতামুহুরী নদী ও রাঙ্গামাটি-থেগামুখ নৌপথ খননের মাধ্যমে নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার শীর্ষক প্রকল্পের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকের কার্যপত্র অনুযায়ী ১ হাজার ২৬১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ওই প্রকল্প শুরু হয়ে ২০২৭ সালের ৩০ জুন শেষ হবে। তবে পিইসি ওই প্রকল্পের বিষয়ে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। সেগুলো সংশোধনে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তারপরই ওই প্রকল্পের কার্যক্রম চূড়ান্ত হবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে প্রতি বছর বন্যায় ৫০ লাখ কিউসেক পানি এবং ২৪০ কোটি টন পলি পরিবাহিত হয়। যা সমগ্র বিশ্বের পরিবাহিত পলির ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। বিপুল পরিমাণ ওই পলি পরিবহনের ফলে মাছের উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রম ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। একইভাবে বন্যার পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টির ফলে দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সাঙ্গু-মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পাহাড়ের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা সহজ হবে। তাছাড়া নৌপথে যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রুতগামী নৌযান চলাচল ব্যবস্থার জন্য সাঙ্গু, মাতামুহুরী এবং কর্ণফুলী নদীর রাঙ্গামাটি-মারিশ্যা ও রাঙ্গামাটি-থেগামুখ পর্যন্ত নাব্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার পাহাড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৫ প্রজাতির প্রায় ১৭ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়। পরের বছর উৎপাদিত হয় প্রায় ১৯ লাখ টন। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় ওসব এলাকার চাষীরা তাদের উৎপাদিত ফল ভালোভাবে বাজারজাত করতে পারে না। ফলে তারা আশানুরূপ লাভবানও হতে পারে না। তাতে পাহাড়ের সম্ভাবনাও পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। নৌপথে যদি ওসব ফল বাজারজাত করা সম্ভব হয় তাহলে চাষীরা আরো লাভবান হবে। তাতে পাহাড়ি অঞ্চলে ফল ও পণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা আরো বাড়বে।
সূত্র আরো জানায়, প্রকল্পের আওতায় মাটির ডাইক নির্মাণ হবে ২২ লাখ ৮৯ হাজার ঘনমিটার, ক্যাপিটাল ড্রেজিং ১৮১ লাখ ঘনমিটার, এক্সক্যাভেটর দিয়ে ৮৫ লাখ ২০ হাজার ক্যাপিটাল খনন করা হবে। তাছাড়া সংরক্ষণ ড্রেজিং ৪৪ লাখ ৮৬ হাজার ঘনমিটার এবং নদীর তীর প্রতিরক্ষামূলক কাজ ৫ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার, পরামর্শক সেবা, ফসলের ক্ষতিপূরণ, প্রকৌশল জরিপ ৪১ দশমিক ৬৭ বর্গকিলোমিটার, হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ ২ হাজার ১৩০ কিলোমিটার ওসব কার্যক্রম ওই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ওই প্রকল্পে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক বাস্তবায়িত একই ধরনের প্রকল্পের তুলনায় মাটির ডাইক নির্মাণে প্রতি ঘনমিটারে ৫০ টাকা করে বেশি প্রস্তাব করা হলেও কমিটি তা যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে। প্রকৌশল জরিপের ব্যয়ও কমিয়ে আনার নির্দেশ দেয়া হয়। তাছাড়া প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী মোট ড্রেজিং কার্যক্রমের ৩০ শতাংশ করবে বিআইডব্লিউটিএ এবং বাকি ৭০ শতাংশ করবে বেসরকারি ড্রেজার প্রতিষ্ঠান। সেক্ষেত্রে বেসরকারি ড্রেজিংয়ের ব্যয় প্রতি ঘনমিটারে ১০০ টাকা বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই ব্যয়ও যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে। ওই প্রকল্পের আওতায় ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ১০টি ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং ১০টি ল্যাপটপ, ১৪টি প্রিন্টার, ৪টি ফটোকপিয়ার, ৪টি স্ক্যানার, ৬টি ফ্যাক্স ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে এ বিষয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চেšধুরী জানান, পাহাড়ি অঞ্চলে নানা ধরনের ফলসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন হয়। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় অনেক সময় সেসব পণ্য বাজারজাত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেজন্য পাহাড়ি অঞ্চলে উদ্যোক্তা চাষীদের অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে ওই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তাছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ওই অঞ্চলে নৌ-যোগাযোগ বাড়বে। প্রকল্পটি নিয়ে এরই মধ্যে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভায় বেশকিছু পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে। সেগুলো সংশোধনের কাজ চলছে।