দেশের রেললাইন ঘিরে আশঙ্কাজনক হারে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। ট্রেনের ধাক্কায় বা ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। তাছাড়া রেলক্রসিংয়ে (লেভেল ক্রসিং) ট্রেনের সঙ্গে অন্য যানবাহনের সংঘর্ষেও প্রাণহানি ঘটনা ঘটছে। রেললাইন থেকে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২ জনের মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। মাসে গড়ে ৬৪ জনের প্রাণ যাচ্ছে। রেলওয়ে পুলিশের তথ্যানুযায়ী ৩ বছরে শুধু রেললাইনে ২ হাজার ৩১১ জনের লাশ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে পুরুষ এক হাজার ৭৬৩ জন আর নারী ৫৪৮ জন। রেললাইনে ছাত্রছাত্রীর মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। প্রতিবছর রেললাইনে গড়ে ৬২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে। গত ২ বছরে ১২৪ জন ছাত্রছাত্রী মারা গেছে। কিন্তু রেললাইনে মৃত্যুর একটি বড় অংশের কারণই চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। ফলে দুর্ঘটনা নাকি হত্যা করে লাশ রেললাইনে ফেলে রাখা হয়েছে তা স্পষ্ট না হওয়ায় অপরাধীরাও পার পেয়ে যাচ্ছে। কারণ কিছু ঘটনায় হত্যার আলামত নষ্ট করতে দুর্বৃত্তরা রেললাইনে লাশ ফেলে যায়। তাতে ট্রেনের চাপায় লাশ ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পাশাপাশি তদন্তও ধামাচাপা পড়ে যায়। বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৯ সালে রেললাইনে মোট ৯৮০ জনের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে পুরুষ ৭৩১ ও নারী ২৪৯ জন। আর ২০২০ সালে ৭১৩ জন এবং ২০২১ সালে ৬১৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালে নিহতদের ৭০ জনের বয়সই ১৮ বছরের নিচে ছিল। ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সের ছিল ৬৫৮ জন। আর ২৫২ জনের ৫০-এর বেশি বয়স ছিল। ২০১৯ সালে রেললাইনে ৭৮ ছাত্রছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালে ওই সংখ্যা ছিল ৪৬ জন। রেললাইনে মারা যাওয়া অধিকাংশ মানুষই ছিল শ্রমজীবী। ২০১৯ সালে ৪৩৩ জন শ্রমজীবী রেললাইনে লাশ হয়েছে আর ২০২০ সালে ৩৯৫ জন। তাছাড়া ২০১৯ সালে ৮০ জন চাকরিজীবী রেললাইনে মারা গেছে। ২০২০ সালে ওই সংখ্যা ৬ জন।
সূত্র জানায়, রেললাইনে লাশ হওয়ার একটি বড় কারণ অজ্ঞাত। মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করতে না পারায় মৃত্যুর দায়ও অজানা থেকে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে ৩৮৯ জনের মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা যায়নি। ২০২০ সালে ওই সংখ্যা ছিল ২১। রেললাইনে হাঁটার সময় কানে ইয়ারফোন দিয়ে কথা বলার কারণে ২০১৯ সালে ৩৭ জন মারা গেছে। ২০২০ সালে ওই সংখ্যা ছিল ৯ জন। তাছাড়া রেলক্রসিং দ্রুত পার হতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ২০১৯ সালে ওই সংখ্যা ছিল ৩৭২ জন আর ২০২০ সালে ৩৬৬ জন। প্রাণ যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো রেললাইনের ওপর দিয়ে বাস বা অন্যান্য যানবাহনের চলাচল। ২০১৯ সালে ওই কারণে ৩৬৬ জনের প্রাণ গেছে। ২০২০ সালে ওই সংখ্যা ছিল ২২৮ জন। আর ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ার কারণেও অনেকে মারা যাচ্ছে। তাতে ২০১৯ সালে ১৪ জন মারা গেছে আর ২০২০ সালে মারা গেছে ২ জন। মূলত সচেতনতার অভাব, অরক্ষিত ক্রসিং, অননুমোদিত ক্রসিং, গেটম্যান না থাকা, ঝুঁঁকিপূর্ণ লাইন ও সেতু এবং রেললাইন ঘিরে হাটবাজার গড়ে ওঠায় প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে রেল ঘিরে এতো বিশাল বিনিয়োগের পাশাপাশি নিরাপত্তার দিকে নজর না দেয়ায় প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে। পৃথিবীর কোনো আধুনিক ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাটিতে রেখে রেলের তিন বা চার লাইনের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক করা হচ্ছে না। সড়ক, নৌ ও রেলপথে যাত্রীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়েই যুগ যুগ ধরে রেলপথকে সবচেয়ে নিরাপদ বলে বিবেচনা করা হয়। ব্রিটিশরা ৪৪৪ ধারায় দ্রুতগতির যান হিসেবে রেলের চালককে দায়মুক্তি দিয়ে গেছে। তার অর্থ হলো রেলের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে চালক রেহাই পাবেন। আর রেললাইনের ১৫ ফুটের মধ্যে কোনো স্থাপনা বা বসতি থাকার কথা না থাকলেও বাস্তবে থাকছে। ফলে বাধ্য হয়েই মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে অহরহ রেললাইন পার হতে হচ্ছে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে রেলওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি দিদার আহমেদ জানান, রেললাইনে কোনো লাশ পাওয়া গেলে সাধারণত ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল ছাড়া স্বজনকে মরদেহ দেয়া হয় না। কারণ সব মৃত্যুই যে দুর্ঘটনায় তা রেলপুলিশ মনে করে না। দুস্কৃতকারীরাও অনেক সময় হত্যার পর রেললাইনে লাশ ফেলে যেতে পারে। সম্প্রতি কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ফেনীতে এমন কয়েকটি ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা যায়, হত্যার পর লাশ রেললাইনে ফেলে যায় খুনিরা। তাই যে কোনো মৃত্যুর পর দালিলিক সাক্ষ্য-প্রমাণ সংরক্ষণ করা হয়।