ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ‘লাগেজ পার্টির’ মাধ্যমে অবৈধভাবে নানা ধরণের পণ্য আনা যেন একেবারে ওপেন সিক্রেট। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত বিষয়ে অভিযোগ উঠলে একাধিক কর্মকর্তা বদলি হলেও চিত্র একেবারেই পাল্টায়নি।
বৃহস্পতিবার লাগেজ পার্টির একটি চালান আটক করতে অনেকটা বাধ্য হয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। একপর্যায়ে ছেড়ে দেওয়ারও চেষ্টা করে। সাংবাদিকরা চ্যালেঞ্জ করলে কিছুটা পিছু হটেন। তবে শেষ পর্যন্ত নানা টালবাহানার পর তারা নামকাওয়াস্তে শুল্ক আদায় করে পণ্য বহনকারিদেরকে ছেড়ে দেয়। ব্যাগেজ সুবিধার বাইরে পৌণে ছয় লাখ টাকার পণ্য আনার কথা উল্লেখ করে ৮৩ হাজার টাকা শুল্ক আদায় করে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওই যাত্রী বিশেষ ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে দেশে এসেছেন। সাংবাদিকদেরকে সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এসব পণ্য ব্যবসার জন্যই আনা বলে স্বীকার করেন। তবে পণ্যের মালিক তিনি নন বলে জানান। পণ্যগুলো চট্টগ্রামের নিয়ে যেতেন বলে উল্লেখ করেন।
যাত্রীদের ব্যাগেজ সুবিধার আওতায় উল্লেখ আছে, বিদেশ ফেরত যাত্রী যুক্তিসংগত পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য, পরিধেয় গৃহস্থালী বা অন্যবিধ সামগ্রী ১৫ কেজি নিতে পারবেন। এর বেশি হলে তাকে নিয়ম অনুসারে শুল্ক সুবিধা দিতে হবে। এক বছরে তিনি তিনবার ৪০০ ডলার পর্যন্ত দামের পণ্য নিয়ে যেতে পারবেন।
একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকালে ধনঞ্জয় দে ও রূপা দে নামে দুই ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাদের কাছে বড় আকারে পাঁচটি ব্যাগ ছিলো। স্থানীয় এক ব্যবসায়ি বিষয়টি গোপনে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। প্রথমে টালবাহানা করলেও একপর্যায়ে ব্যাগে কি আছে জানতে চায়। এরইমধ্যে তাদের ব্যাগ তল্লাশি না করতে ছুটে আসেন এক গণ মাধ্যমকর্মী। সামান্য জরিমানা করা হবে শর্তে ধনঞ্জয়কে দিয়ে ওই সাংবাদিকের সামনে ব্যাগ খোলান কাস্টমস কর্মকর্তারা। এরইমধ্যে এ প্রতিবেদকসহ স্থানীয় একাধিক সাংবাদিক কাস্টমস কার্যালয়ে উপস্থিত হন।
উপস্থিত হওয়া পরিচয় জানার পর শুরু থেকেই সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক পণ্যের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন। একেকজন যাত্রী ৪০০ ডলারের সমপরিমাণ পণ্য কিংবা ১৫ কেজি ওজন পর্যন্ত পণ্য নিতে পারবেন বলে জানান তিনি। সেই হিসেবে অতিরিক্ত ৬৫টি থ্রি-পিস ধনঞ্জয়দের বহন করা লাগেজে পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। সাংবাদিকরা এ নিয়ে আপত্তি তুললে তড়িঘড়ি করে আবার ধনঞ্জয়কে দিয়েই ব্যাগের কাপড় গণনা শুরু করান। তখন তিনি মোট ৯৯ টি পোশাক অতিরিক্তি বলে জানান। সাংবাদিকরা আবার চ্যালেঞ্জ করলে পাঁচটি ব্যাগ খুলে প্রায় ২৯৪টি পোশাক পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৭০টি থ্রি-পিস, ২০৬টি টি শার্ট, ১৮টি জিন্স প্যান্ট রয়েছে। ব্যাগে একাধিক মদের বোতলও পাওয়া যায়।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, করোনা শুরুর পর থেকে ভারত থেকে এভাবে পণ্য আসা শুরু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সেটি বেড়ে যায়। বিশেষ করে কলকাতা থেকে পোশাকসহ কসমেটিকস। এ ক্ষেত্রে সেখানকার ব্যবসায়িরা লোক দিয়ে এসব পণ্য পাঠান। এসব পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় যায়। বাংলাদেশের ব্যবসায়িদের পাশাপাশি স্থানীয় কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীও এর সঙ্গে জড়িত। কাস্টমসসহ বন্দরের সংশ্লিষ্টদেরকে ম্যানেজ করে তারা অবাধে এসব পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন। ৫০ এর অধিক ভারতীয় দম্পতি এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।
সূত্রটি জানায়, কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের ব্যবসায়িদের মধ্যে অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এরই অংশ হিসেবে একজন আরেকজনের পণ্য ধরিয়ে দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবারও একটি পক্ষ এ পণ্য ধরিয়ে দেন। ব্যবসায়িরা স্থানীয় সাংবাদিকদেরকে ব্যবহার করে এসব পণ্য দেদারছে নিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলেই ভারতীয় নাগরিক ধনঞ্জয় দে এক ব্যক্তির নাম মালিক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘ব্যবসার জন্যই এসব পণ্য দেওয়া হয়েছে। আমি শুধু পণ্য বহন করার মালিক। আর কখনো বাংলাদেশে আসেনি। আমাকে চট্টগ্রাম যেতে বলা হয়েছে। এর বাইরে আমি কিছুই জানি না। আমার ছবি আপনারা কোথাও দিবেন না। তাহলে মুখ দেখাতে পারবো না।’
সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক বলেন, ‘ওই যাত্রী কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে পণ্য নিয়ে যেতে চাইছিলেন। তার ব্যাগ তল্লাশি করে ব্যাগেজ সুবিধার বাইরে বাইরে যা পাওয়া গেছে সেগুলোতে শুল্ক ধরা হয়।’ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে ঢোকার পথে এ সুবিধা পাবেন কি-না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি ঢাকায় যাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন। পরে তিনি যে নিয়ম পাঠান সেটিতে বিদেশ ফেরত যাত্রী ব্যাগেজ সুবিধা পাবেন বলে উল্লেখ থাকতে দেখা যায়।