স্বাধীনতা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে পাবনা জেলার অন্যান্য উপজেলার ন্যায় সুজানগর উপজেলারও রয়েছে এক রক্তাক্ত ও গৌরবান্বিত ইতিহাস। পাবনা জেলার মধ্যে সুজানগর একটি পশ্চাতপদ এবং অবহেলিত উপজেলা হলেও মহান মুক্তিযুদ্ধে এ জনপদের মানুষের রয়েছে সীমাহীন আত্মত্যাগ এবং অন্যন্য ভূমিকা।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পথভ্রষ্ট পাকহানাদার বাহিনী বিনা উস্কানীতে ঢাকায় নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির উপর হামলা চালিয়ে নজিরবিহীন গণহত্যা চালায়। রক্ত পিপাসু দখলদার হানাদার বাহিনীর এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের খবর সারা দেশের ন্যায় সুজানগর এসে পৌঁছালে মূলতঃ এদিন থেকেই সুজানগরের মুক্তিকামী নির্ভীক দামাল ছেলেরা পাকহানাদার বিরোধী আন্দোলনে ফুঁসে উঠেন। এরই মাঝে নরপিশাচ বর্বর পাকিস্তানী ঘাতকরা সুজানগরে এসে তৎকালীন সুজানগর পি,এস (পুলিশ স্টেশন) ও সুজানগর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ঘাঁটি করলে পাকিস্তানীদের কতিপয় দোসর ব্যতীত সুজানগরের আপামর জনসাধারণ একটি স্বাধীন সার্বভৌম মানচিত্রের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। কিন্তু আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীন সর্বভৌম ভূখ- ছিনিয়ে আনতে হলে কেবল আত্মবল আর দুর্দান্ত সাহসইতো যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন আধুনিক অস্ত্র ও দক্ষ প্রশিক্ষণ। আর তাইতো সেদিন প্রয়োজনের তাগিদে সুজানগরের তিন শতাধিক মুক্তিকামী নানা বয়সী মানুষ ছুটে যান ভারতের কেচুয়াডাঙ্গা, জলংঙ্গী, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং তরঙ্গপুর এবং মহাদেবপুরসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। তারা সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক পাবনা-২ আসনের প্রয়াত এমপি আহম্মেদ তফিজ উদ্দিন মাস্টার, পাবনা-৫ আসনের প্রয়াত এমপি ওয়াজিউদ্দিন খানসহ বিভিন্ন দেশ প্রেমিক ব্যক্তির সহযোগিতায় দক্ষ প্রশিক্ষণ এবং ভারি অস্ত্র নিয়ে সুজানগরে পারি জমান। এরইমধ্যে হানাদারবাহিনী ৩রা মে সুজানগ এবং ১২ মে সাতবাড়ীয়া হামলা চালিয়ে বসন্ত পাল, জগবন্ধু পাল, সুরেশ চন্দ্র, লক্ষèী কান্ত, বিনয় সাহা, লোকমান হাকিম, ক্ষিতিশ পাগলা, মন্তাজ মোল্লা এবং রঞ্জিত কুমার সরকারসহ প্রায় ২ হাজার নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হতে করে। সে সময় সাতবাড়ীয়ায় রচিত হয় গণকবর। এরপর প্রশিক্ষিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন। তারা তখন প্রয়াত এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল, জহুরুল ইসলাম বিশু এবং ইকবাল হোসেনসহ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকদের নেতৃত্বে সুজানগরের বিভিন্ন ইউনিয়নে অবস্থান নিয়ে হানাদার বিরোধী অপারেশন শুরু করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলার বনদপুরে পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকারদের উপর হামলা চালিয়ে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে নেন। সেই সঙ্গে তারা নাজিরগঞ্জ সংলগ্ন পদ্মা নদীতে অবস্থান নিয়ে পাকসেনাদের একটি কার্গোর উপর হামলা চলিয়ে কার্গোটি ধ্বংস করাসহ কার্গোতে অবস্থানকারী ২৫/৩০ জন পাকসেনাকে গুলি করে হত্যা করেন। পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ সময় পাবনা সদরের শ্রীকোল ব্রীজটি ভেঙ্গে ফেলে হানাদার বাহিনীকে পাবনা শহর থেকে সুজানগরে আসার পথ বন্ধ করে দেন। ১৯৭১’র ১জুলাই থেকে এভাবে পাকবাহিনীর সাথে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার একপর্যায়ে ৯ই ডিসেম্বর নাজিরগঞ্জ বাজার এবং ১১, ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর সুজানগর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় ও সুজানগর পুলিশ স্টেশন এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সুজানগরে টানা তিনদিন সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একপর্যায়ে ১৪ই ডিসেম্বর সুজানগর হানাদার মুক্ত হয়।
যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর, ইব্রাহীম মোস্তফা কামাল দুলাল ও নূরুল ইসলাম নূরু শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এদের মধ্যে উপজেলার উলাট গ্রামের সাইদুর রহমান সাইদ হানাদারদের গুলিতে অন্ধত্ব বরণ করেন।