বাড়ির সীমানা নিয়ে বিরোধের জেরে সৃষ্ট হত্যা মামলায় জামিন পেয়েও বাড়িঘরে উঠতে পারছেন না কিশোরগঞ্জ সদরের দুটি অসহায় পরিবার। প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসী হামলার মুখে তারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকছেন। তাদের কৃষি জমি পতিত পড়ে আছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারছেন না।পবিত্র মাহে রমজানুল মুবারকের রোজা রাখতেও ব্যাঘাত ঘটছে তাদের। বাড়িতে যেতে না পারায় তাদের পরিবারের স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা পড়ুয়া চার মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবারের ৮০ বছরের এক বৃদ্ধা বাইরে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
গতকাল সকালে এ দুটি পরিবারের বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ সদস্য কিশোরগঞ্জ শহরের কাজী নজরুল ইসলাম সরণির একটি অনলাইন টিভি চ্যানেল কার্যালয়ে এসে আশ্রয় নেন। পরে সাংবাদিকদের ডেকে সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, 'আমরা খুব কষ্টে আছি। আমাদের নিরাপত্তা নেই। আমরা বাড়ি ফিরতে পারছি না। আমরা বাড়িতে থেকে অন্তত রোজাগুলো রাখতে চাই। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন।'
আতঙ্কিত দুটি পরিবারের সদস্যদের বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার রশিদাবাদ ইউনিয়নের রশিদাবাদ গ্রামের দামোয়ারবাড়ি। সংবাদ সম্মেলনে পরিবারের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র মো: রাজিব, তার মা নাহার বেগম, চাচা দেলোয়ার হোসেন ও চাচি রাবিয়া খাতুন উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাড়ির সীমানা নিয়ে ২০২১ সালের ১৮ মে দামোয়ার বাড়ির মৃত আফতাব উদ্দিনের ছেলে এমদাদুল হক এম্বার এর সাথে মৃত আবুল কাশেমের ছেলে আকবর হোসেনের (রাজিবের বাবা) লোকজনের ঝগড়া হয়। ঝগড়ার সময় মাথায় আঘাত পেয়ে এমদাদুল হক এম্বার আহত হন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চার দিন পর তিনি মারা যান।
এ ঘটনায় আকবর হোসেন (৪০), তার স্ত্রী নাহার বেগম (৩৫), দুই ছেলে মো: সজিব (২৫), মো: রাজিব (১৭), ও আকবর হোসেনের ভাই দেলোয়ার হোসেন(৪৫)কে আসামি করে হত্যা মামলা হয়।
কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার এস আই মো: আবু হান্নান ঘটনার তদন্ত করে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে পাঁচজনকেই আসামি রেখে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
গত ২৪ জানুয়ারি আসামিরা আদালতে হাজিরা দিলে তাদের সবাইকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। মামলায় দুই মাস হাজতবাস করে গত ২৪ মার্চ ২০২২ তারিখে মো: রাজিব, তার মা নাহার বেগম ও চাচা দেলোয়ার হোসেন জামিনে বেরিয়ে আসেন। আকবর হোসেন ও তার বড় ছেলে মো: সজিব এখনো জেলহাজতেই আছেন।
এদিকে মামলা হওয়ার পর থেকেই তাদের বাড়িঘর প্রতিপক্ষের লোকজন ভাঙচুর করে দখলে নিয়ে নেয়। এ পরিস্থিতিতে আসামিপক্ষ ও তাদের পরিবারের লোকজন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন।
গত ১ এপ্রিল শুক্রবার এলাকার জনপ্রতিনিধিদের জানিয়ে মামলার জামিনপ্রাপ্ত আসামি মো: রাজিব, তার মা নাহার বেগম ও চাচা দেলোয়ার হোসেন বাড়িঘরের খোঁজখবর নিতে গেলে এমদাদুল হকের ছেলে রাব্বি, আফতাব উদ্দিনের ছেলে দুলাল, আনোয়ারসহ আরো কিছু লোকজন মিলে তাদের ওপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। একপর্যায়ে রাজিবের চাচাকে আটকে বেদম প্রহার করা হয়। তার মা নাহার বেগমকে একটি ঘরে নিয়ে বন্দি করে রাখে। এ ব্যাপারে গত শনিবার কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মো: রাজিব অভিযোগ করে বলেন, 'আজ অত্যন্ত নিরুপায় হয়ে আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি। আমি কওমি মাদ্রাসায় পড়ি, ঝগড়ার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। ওইদিন আমি মাদ্রাসায় অবস্থান করছিলাম। দুইদিন পর বাড়ির মারামারির ঘটনার বিষয়ে আমি জানতে পারি। তাছাড়া জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ী আমার বয়স ১৬ বছর হলেও ২০ বছর দেখিয়ে আসামি হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি আইনগতভাবে মোকাবেলা করছি আমরা। এখন জামিনে মুক্ত হয়েও বাড়িতে ফিরতে পারছিনা।'
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রাজিব বলেন, আমার বৃদ্ধা দাদীকেও বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে না।'
এ সময় দেলোয়ার হোসেন জানান, বাদী পক্ষের লোকজন তাদের বাড়িতে যেতে না দেওয়া তার চার মেয়ের পড়ালেখা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তারা স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় পড়ছিল। বাড়িতে জমিজমা সব পতিত পড়ে আছে। সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা। দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'আমরা খুব কষ্টে আছি। আমাদের নিরাপত্তা নেই। আমরা বাড়ি ফিরতে পারছি না।
দেলোয়ার হোসেন জানান, আমি বৃহস্পতিবার পাগলা মসজিদের কাছে যেতেই ০১৩০৮০৪৭৮০০ নাম্বারে কল দিয়ে বলে আপনার ভাই আকবরকে জামিন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। জামিনের কাগজ কোর্ট থেকে আনতে হবে বলে টাকা চাইলে কথামত ১০ হাজার টাকা দেই। পরে আমাদের রেখে ওই ব্যক্তি কোর্টে গেলে আর ফিরে আসেনি। সেখানে অনেকক্ষন অপেক্ষা করে কারাগারে যোগাযোগ করে জানতে পারি জামিনের কখাটি ভূয়া। আমার সাথে ব্লাকমেইল করে টাকা নিয়ে প্রতারক উধাও হয়ে গেছে। একতো ভাই জেলে আরেক বাড়িঘড়ে যেতে পারছিনা এমতাবস্থায় এখন প্রতারণার কবলে আমরা সর্বস্ব হারাচ্ছি। আমাদেরকে রক্ষা করুন।
কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অফিসার ইনচাজ মোহাম্মদ দাউদ জানান, একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েই এস আই মো: আবু হান্নানকে ঘটনাস্থলে গিয়ে এলাকাবাসী ও বাদীপক্ষকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে বলে আসতে যে আসামীদের বাড়িঘড়ে কেউ যেনো প্রবেশ না করে এবং তাদেরকে বাড়িতে অবস্থান করতে সহায়তা করে।