ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পদ্মা নদীর অপর পার এলাকায় রয়েছে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলা সীমানা। দোহার উপজেলা পদ্মা নদীর মাঝিরচর থেকে নারিশা বাজার হয়ে মোকছেদপুর গ্রাম পর্যন্ত প্রায় ১২ কি.মি. এলাকা ড্রেজিং প্রকল্পর নামে বাস্তবে খনন করা হচ্ছে চরভদ্রাসন উপজেলা সদর ইউনিয়ন ও চরঝাউকান্দা ইউনিয়নের পদ্মা নদীর বিভিন্ন চরাঞ্চল। সংশ্লিষ্ট মহল সম্পূর্ন স্বেচ্ছাচারীতা ও খামখেয়ালীপনা করে কোনো প্রকার অনুমোদন ছাড়াই প্রকল্প বহির্ভূত এলাকা চরভদ্রাসন ইউনিয়ন ও চরঝাউকান্দা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত পদ্মা নদী চরগুলো ড্রেজ করে চলেছে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। ফলে চরভদ্রাসন উপজেলা পদ্মা নদীর বিভিন্ন চরে ড্রেজিংয়ের উত্তোলিত বালু স্তুপ ফেলে অন্ততঃ দেড় হাজার একর উর্বরা ফসলী জমি সহ চরাঞ্চলের বিভিন্ন দুস্থ পরিবারের বসতভিটে ধ্বংস করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যপারে গত ৪ এপ্রিল চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাহী অফিসার তানজিলা কবির ত্রপা, উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোঃ কাউছার, ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আজাদ খান ও ফরহাদ হোসেন মৃধা ক্ষতিগ্রস্থ চরাঞ্চলগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরে চরভদ্রাসন পদ্মা নদীতে অনুমোদন বিহীন ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করার ফলে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির বিবরন সম্বলিত একটি প্রতিবেদন তৈরী করেন ইউএনও। প্রতিবেদনটি তিনি ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার দপ্তর, নির্বাহী প্রকৌশলী, ঢাকা পাওর বিভাগ, প্রধান প্রকৌশলী, পশ্চিমাঞ্চল, বাপাউবো, ফরিদপুর ও পিএস টু সিনিয়র সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে দাখিল করলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অনুমোদনহীন ড্রেজিং কার্যক্রম বন্ধ হয় নাই।
এছাড়া শনিবার (৯ এপ্রিল) বিকাল ৩ টায় চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদ চত্তরের সামনে ‘চর বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও’ দাবী নিয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন স্থানীয় সর্বমহল। মানববন্ধনের পর এলাকাবাসী জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন। এ মানববন্ধন কর্মসূচীর সভাপতিত্ব করেন সদর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আজাদ খান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেরা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোঃ কাউছার। মানববন্ধনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন, শেখ মোঃ মনিরুজ্জামান মাষ্টার, ইউপি সদস্যবৃন্দ ও ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা। বক্তারা বলেন, দোহার উপজেলা পদ্মা ড্রেজিং প্রকল্পর নামে চরভদ্রাসন উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চল কেটে নদীর গতি প্রবাহ ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে পুরো উপজেলা পদ্মা নদীর ভাঙনের হুমকীর মধ্যে পড়বে। একই সাথে চরভুমি ড্রেজিংয়ের উত্তোলিত পাহাড় সম বালুস্তপ মোটা পাইপ লাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন চরের উর্বরা ফসলী জমিতে ফেলা হচ্ছে। এতে হাজার হাজার একর উর্বরা জমি বিনষ্ট হয়েছে। এমনকি প্রভাবশালী ঠিকাদার গোষ্ঠী এলাকার গরীব মানুষের বসতভিটের উপর বালু স্তুপ ফেলে বসবাস অযোগ্য করে রেখেছে। মানববন্ধনে অংশগ্রহনকারীরা অনুমোদনহীন চরভদ্রাসন উপজেলার পদ্মা চর ড্রেজিং কার্যক্রম দ্রুত বন্ধ করা সহ সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের পূনর্বাসনের জোর দাবী তোলেন। এ সময় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক উপজেলার চরঝাউকান্দা ইউনিয়নের দক্ষিন নবাবগঞ্জ গ্রামের রহিম হাওলাদার (৬০) ও সোহরাব খালাসী (৬৫) জানান, “ আশপাশের পাঁচ গ্রামের কোনো ফসলী মাঠ আর বেঁচে নেই, ওই দুই পরিবারের ১২ বিঘাত জমির উঠতি ধান, বাদাম, ভ্ট্টুা, কালিজিরা ও ধনিয়া ফসলী জমির উপর ড্রেজিংয়ের বালু স্থপ ফেলে স্বমূলে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এখন পরিবারগুলো সর্বনিঃস্ব হয়ে পড়েছে বলে তারা হতাশায় ভেঙে পড়েন”।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ঢাকা জেলার দোহার উপজেলা পদ্মা নদীর মাঝিরচর থেকে নারিশা বাজার হয়ে মোকছেদপুর গ্রাম পর্যন্ত ৩শ’ মিটার চওড়া করে প্রায় ১২ কি.মি. এলাকা ড্রেজিং প্রকল্প সম্পন্ন করার জন্য মোট ছয়টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজটি নেন। এসব ড্রেজিং কোম্পানীগুলো হলো-মায়ার ড্রেজ কোং লিঃ, সিসিইসিসি বাংলাদেশ লিঃ, বেঙ্গল ড্রেজিং কোং লিঃ, আহাম্মেদ ইঞ্জিনিয়ারিং লিঃ বে-ড্রেজিং কোং লিঃ ও মীর নাসির ড্রেজিং কোং লিঃ। ওই ড্রেজিং প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যায় প্রায় ১ হাজার ২শ’ কোটি টাকা।
শনিবার উপজেলা পদ্মা নদীর চরঝাউকান্দা ইউনিয়নের বিভিন্ন চরাঞ্চলে অনুমোদনহীন ড্রেজিংরত প্রকল্পগুলোতে সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, ওই ইউনিয়নের উত্তর নবাবগঞ্জ গ্রাম, চরকালিকাপুর, তাহের মোল্যার ডাঙ্গী, শহর মোল্যার ডাঙ্গী ও ঝাউকান্দা চর নামক গ্রামের মাঠের পর মাঠ উর্বরা ফসলী জমিগুলো ড্রেজিংয়ের উত্তোলিত বালু স্তুপ দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। প্রতিটি চরভুমিতে ৫/৬টি করে ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন চরে উত্তোলিত বালু সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে একসাথে অন্ততঃ ৫০টি ড্রেজিং মেশিন চলমান রয়েছে। ড্রেজিং কার্যক্রমগুলো সেনাবাহিনীর তত্তাবধানে সম্পন্ন করা হচ্ছে।
চলমান ড্রেজিং প্রকল্পের এক প্রকৌশলী জহির রায়হান জানান, “অত্র প্রকল্পে দোহার উপজেলার মাঝির চর থেকে নারিশা বাজার হয়ে মোকছেদপুর পর্যন্ত পদ্মা নদীর বামকুল ঘেষে ১২ কি.মি. ড্রেজিং কার্যক্রম রয়েছে। কিন্তু দোহার উপজেলা পদ্মা নদীতে রয়েছে গভীর জলমহল। ফলে দোহার উপজেলা পদ্মা নদী সীমানায় ড্রেজিং কার্যক্রম করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি জানান, ইঞ্জিনিয়ারিং মতে, পদ্মা নদীর জল প্রবাহ সোজা গতি প্রবাহ চালু করতে পারলে নদীর দু’কুলে ভাঙনের শঙ্কা হ্রাস পায়। তাই দোহার ্উপজেলার ড্রেজিং প্রকল্প হওয়া স্বত্তেও পদ্মা নদীর জল প্রবাহ আঁকাবাঁকা না করে সোজা পথে বইয়ে দেওয়ার জন্য চরভদ্রাসন উপজেলা সীমানার পদ্মা নদী খনন করে বৃহৎ স্বার্থে উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলের জমিতে বালু স্তুপ ফেলা হচ্ছে”।
এ ব্যপারে চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাহী অফিসার তানজিলা কবির ত্রপা বলেন, “ আমরা চলমান ড্রেজিং প্রকল্পের কাগজপত্র খতিয়ে দেখেছি, মূলতঃ ঢাকা জেলার দোহার উপজেলা পদ্মা নদী ড্রেজিং প্রকল্প। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা কোনো অনুমোদন ছাড়াই জোর পূর্বক চরভদ্রাসন উপজেলার বিভিন্ন চরভুমি কেটে এবং ফসলী জমিতে বালুস্তুপ ফেলে উপজেলার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে। আমরা বার বার নিষেধ করার পরও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ড্রেজিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাই বিষয়টি ঊর্ধ্বতন দপ্তরে প্রতিবেদন আকারে পেশ করা হয়েছে”। একই দিন ফরিদপুর পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম সাহা বলেন, “ চরভদ্রাসন উপজেলা সীমানায় পদ্মা নদী ড্রেজিং হচ্ছে অথচ আমাদের অবগতই করানো হয় নাই”।