রাজধানীর পল্লবীতে ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের পাঁচটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা অর্ধশতাধিক। তাদের আশ্রয়দাতা হিসাবে আছেন কাউন্সিলর ও চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ীসহ চিহ্নিত কিছু সন্ত্রাসী। কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রনকারীরা হচ্ছে- শেখ মোহাম্মদ আলী আড্ডু মিলন ঢালী গ্রুপ, সুজন-রাসেল গ্রুপ, সুমন -বিপ্লব গ্রুপ, সাগর গ্রুপ ও জয় গ্রুপ। গত দুই মাসে গ্যাংবিরোধী অভিযানে মাত্র চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কোনো আশ্রয়দাতা এখনো গ্রেফতার হয়নি। তবে পুলিশ জানিয়েছে, আশ্রয়দাতা হলো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। তাদের গ্রেফতার করতে হলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। তারপরও তালিকা ধরে অভিযান শুরু হয়েছে। এই কিশোর গ্যাংয়ের অত্যাচারে ব্যবসায়ীসহ এলাকা বাসিরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এলাকা বাসিদের অভিযোগে জানা যায়, কিছু পুলিশ সদস্যদের কারণে কিশোর গ্যাংয়েরা এলাকায় দাপর্টে একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে। পল্লবীর সি ব্লকের কাপড় ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম জানান, ওই সব কিশোর গ্যাংয়ের কারণে ঠিকমত ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারচ্ছে না। তাদের কথা হলো ব্যবসা করতে হলে চাঁদা দিতে হবে না হলে ব্যবসা বন্ধ করতে হবে! এ ছাড়াও এলাকা বাসিকে শান্তিতে বসবাস করতে দিচ্ছে না তারা। আবার মাদক ব্যবসা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে তারা। এ বিষয়ে পুলিশের পল্লবী জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) আরিফুল ইসলাম বলেন, তালিকায় যাদের নাম এসেছে তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। আশ্রয়দাতাসহ সবাই আমাদের নজরদারিতে আছে। তালিকাভুক্ত চারজনকে গ্রেফতার করে দুই মামলায় চালান দিয়েছি। তালিকার বাইরেও সান্দেহভাজন অনেককে আটক করে থানায় এনেছি। যাদের অতীত রেকর্ড খুব একটা খারাপ নয় তাদের মুচলেকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছি। আশ্রয়দাতাদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাই তাদের বিষয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। তবে অন্যান্যের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার কিছু নেই। অভিযান চলছে।তিনি বলেন, তালিকা তৈরির কাজ আগে থেকেই চলছিল। সম্প্রতি টিকটক হৃদয় বাবু ও তার সহযোগীদের মাধ্যমে ভারতে তরুণী নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশের পর তালিকা ধরে অভিযান শুরু হয়েছে। একই ধরনের তথ্য জানিয়ে পল্লবী থানার ওসি পারভেজ ইসলাম বলেন, তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাং সদস্যরা মাদক সেবন, অটোরিকশার টোকেন বাণিজ্য, যৌন হয়রানি, জমি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং খুনসহ নানা অপকর্মে জড়িত। এদের ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিশোর গ্যাংয়ের শেল্টারদাতাদের বিষয়ে আমাদের অনুসন্ধান চলছে। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পেলেই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।পুলিশের তালিকায় এক নম্বরে সুজন-রাসেল গ্রুপের নাম এসেছে। তার পরে শেখ মোহাম্মদ আলী আড্ডু ও মিলন ঢালীর নাম এসেছে। নান্নু মার্কেট সহ ওই সব এলাকা, বাউনিয়া বাঁধ ও পলাশনগর এলাকার আতঙ্ক এ গ্রুপের সদস্যরা। এদের বিরুদ্ধে মাদক সেবন, দখল বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। গত বছর পলাশনগরে একটি বাড়ি দখল করতে গিয়ে গুলি করে গ্রুপটির সদস্যরা। এতে ভিকটিম থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে আদালতে মামলা করে ভুক্তভোগী। তালিকা অনুযায়ী, এ গ্রুপের সদস্যরা হলো-রিয়াজ ওরফে মাওড়া রিয়াজ (১৭), রতন (১৭), নাজমুল (১৮), মামুন (১৭), বাবু ওরফে ইয়াবা বাবু (১৫), লিজা (১৬), টিটু (১৭) এবং রাব্বি (১৭)।তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সুমন ও বিল্পব গ্রুপের নাম। শাহিনুদ্দিন হত্যা মামলায় গ্রেফতারের পর এখন কারাগারে আছেন এই গ্রুপের প্রধান সুমন ব্যাপারী। হত্যা, মাদক এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ সুমনের নামে রয়েছে অনেক মামলা। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কাউন্সলার হলেন এই গ্রুপের গডফাদার। তবে এ-সংক্রান্ত পুলিশের তৈরি করা প্রতিবেদনে তার নাম নেই। এই গ্রুপের সদস্য হচ্ছে- সোহেল (১৭), আপন আহম্মেদ (১৮), ওনি (১৭), সাগর (১৫), দিপু (১৬), কালু (১৭), রবিন (১৫), ফজল (১৭), রনি (১৭), মো. নাদিম (২৩), বাপ্পি (১৮), রকি (১৮), সাব্বির (১৯), সাগর (১৬), মিল্টন (১৮), কোকা ওরফে প্রকাশ (৩২), মো. সেলিম (১৮), বড় আল আমিন (১৭), সমিউল ইসলাম শাওন (১৮) ও রনি (১৭)।পুলিশ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিপ্লবের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক ব্যবসা, জমি দখল এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপ্লবকে আশ্রয় দেয় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সহসভাপতি কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক। কাউন্সিলর আশ্রিত এ গ্রুপের সদস্যরা হলো-লিটন (৩৫), মাহবুব (১৭), রমজান সরদার জয় (১৮), রজ্জব (১৭), আল আমিন (১৬) এবং খোকন (১৮)। এদিকে ৯ জুন রাজধানীর মিরপুর, শেরেবাংলা নগরসহ কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ১৮ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের কয়েকজন জানিয়েছে, তারা কাউন্সিলর মানিকের হয়ে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা এবং ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর মানিক বলেন, তালিকাটি আমি দেখেছি। সেখানে সরাসরি আমি কিশোর গ্যাং সদস্যদের আশ্রয় দিই বলে উল্লেখ করা হয়নি। বলা হয়েছে, তারা কিশোর গ্যাং সদস্যদের আশ্রয় দেয়। এটা যদি সত্য হয়। তাহলে আমাকে কে আশ্রয় দেয়? তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। মন্ত্রী পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি আরও বলেন, আমি কখনো কিশোর গ্যাং সদস্যদের আশ্রয় দিই না। যারা গ্যাং সদস্যদের আশ্রয় দেয় তারাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তালিকায় আমার নাম ঢুকিয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা রাজনীতি করি। তাই আমাদের কাছে অনেকে আসেন এবং ছবি তোলেন। পরে তারা যদি ওই ছবি দেখিয়ে কোনো অপকর্ম করে সেই দায়ভার আমার নয়। তারপরও সম্প্রতি আমি যার-তার সঙ্গে ছবি তুলি না।ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক আরও বলেন, কিশোর গ্যাং তৎপরতাসহ কোনো অপকর্মে আমার সমর্থন নেই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বিশেষ উদ্দেশ্যে তালিকায় আমার নাম দিয়েছে। আমার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। আমার বিরুদ্ধে ধর্ষণের যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটিও মিথ্যা।পুলিশ জানায়, সাগর গ্রুপকে আশ্রয় দেয় এক ওয়ার্ড কমিশনার। তার সঙ্গে সখ্য রয়েছে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন ও জামিলের। সাগর গ্রুপের সদস্যরা হলো-পারভেজ (১৬), তুরাগ (১৭), জাকারিয়া (২০), রাব্বি (১৬), মোবারক (১৭), মুন্না (১৮), ফয়সল (১৮) ও রাজু (১৭)।