খাদ্য উৎপাদনে এগিয়ে থাকা স্বত্বেও সরকারী
পৃষ্ঠপোষকতা, ব্যাংক ঋণ ও প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার অভাবে কৃষিভিত্তিক শিল্প
প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না শেরপুর জেলায়। ফলে জেলার হাজার হাজার শিক্ষিত,
অল্পশিক্ষিত যুবক-যুবতি বেকার জীবনযাপন করছেন। অনেকে মাদক, সন্ত্রাস,
চাঁদাবাজি ও চোরাকারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। অথচ সরকারী বেসরকারি বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ জেলার দ্রুত কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন
করা সম্ভব। ইতোমধ্যে জেলার বিভিন্ন বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র বেশ কিছু ছোট ছোট উদ্যোক্তা সৃষ্টির খাদ্য সংশ্লিষ্ট শিল্প
প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
শেরপুর খামার বাড়ির হিসাব অনুযায়ী জেলার মোট আবাদি জমি ১ লাখ ৩ হাজার ৯ শ
হেক্টর, মোট পতিত জমির পরিমাণ ৪৬০ হেক্টর, এক ফসলি জমি ৭ হাজার ৬৫৩
হেক্টর, দুই ফসলি জমি ৭৬ হাজার ৩৬২ হেক্টর, তিন ফসলি জমি ১৯ হাজার ৯০১
হেক্টর। জেলার মোট খাদ্য উৎপাদন ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩ মেট্রিক টন। জেলার
খাদ্য চাহিদার পরিমাণ ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৯৩ মেট্রিক টন।
এ জেলায় ধান, পাট, গম, আখ, ভুট্টা, তামাক, সরিষা, বাদাম, কলাই, বিভিন্ন
ডাল, তুলা, আলু, মরিচ, পিয়াজ, টমেটো, করলা, সিম, বেগুন, কাকরল, শিমলা আলু
বা কাসাভা, কলা, আম, কাঁঠাল, তরমুজসহ প্রচুর পরিমাণ শাক-সবজি উৎপন্ন হয়ে
থাকে। এ ছাড়া সীমান্তের গারো পাহাড়ি এলাকায়, মাল্টা, কমলা, ড্রাগন ফলসহ
বিভিন্ন জাতের কুল, কাসাভা বা শিমলা আলু, রাবার, চা, আগর সহ বিভিন্ন
মূল্যবান গাছ থেকে সংগ্রহ করা কাঁচামাল দিয়ে গড়ে উঠতে পারে বিভিন্ন শিল্প
প্রতিষ্ঠান। এসব কাঁচামাল ও ফলমূল সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক
হিমাগার ও প্রক্রিয়া করন প্রতিষ্ঠান না থাকায় চাষিরা উৎপাদিত ফসলের
ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। যদিও শেরপুর শহরের শেরী পাড়া
এলাকায় ১ হাজার মেট্রিক টন এবং নকলায় ৫০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন
দুটি সরকারী আলু বীজ সংরক্ষণের জন্য হিমাগার এবং খাওয়ার আলু সংরক্ষণের
জন্য বিসিক মাঠে ১ হাজার ৩ শ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি
হিমাগার রয়েছে। কিন্তু শেরপুরে যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয় সে তুলনায় ওই
হিমাগার খুবই অপ্রতুল। এ ক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারিভাবে আরো হিমাগার
প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
শেরপুর জেলায় স্থানীয় কাঁচামাল সজলভ্যতা ও চাহিদাভিত্তিক অটো রাইস মিল,
আটা মিল, মুড়ি ও চিড়া মিল, তেল মিল, ময়দা মিল, ব্রেড এ- বিস্কুট
ফ্যাক্টরি, মসলা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, মিনি পেপার মিল, পেপার বোর্ড,
দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, স্পেশালাইজ বা সবজী সংরক্ষণ হিমাগার, চিড়া
কল, চাল কল ইন্ডাস্ট্রি, ফলমূল দিয়ে জ্যাম-জেলিসহ গারো পাহাড়ের সাদা মাটি
সুষ্ঠু উত্তোলন নিশ্চিত করে এখানে সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা সম্ভব।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে একই ধারা বজায় রাখার ক্ষেত্রে জেলার ছোটবড় ৮টি
নদ-নদী থেকে সহজে সেচ সুবিধা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য
সেচযন্ত্র যেমন গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, টিউবওয়েল, পাওয়ার পাম্প
প্রভৃতির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আবাদি জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
শেরপুরে কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে মৎস্য সম্পদের জন্য
শেরপুর জেলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে ৭২টি সরকারি, ১৩ হাজার ১৬৬টি বেসরকারি
পুকুর রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ৮টি নদী ও খালবিলসহ ৫০টি উন্মুক্ত জলাশয়।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর অর্থের অভাবে পুকুর, দীঘি ও জলাশয়গুলো
বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদের অভাবে অনাবাদী পড়ে আছে। সরকারী সুযোগ সুবিধা,
নিরাপত্তা এবং মূলধন সরবরাহ করা গেলে এ জেলায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাছ
উৎপাদন করা সম্ভব। জেলায় মাছ চাষের ব্যাপক উন্নয়নের লক্ষ্যে এক যুগ আগে
শ্রীবরদী উপজেলার কুড়িকাহনিয়া ইউনিয়নের ইন্দিলপুর গ্রামে ১.৫৯ একর জুড়ে
একটি মিনি হ্যাচারি প্রতিষ্ঠা করা হলেও তা দীর্ঘ দিন যাবত পরিত্যক্ত
অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
কৃষি বিষয়ক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে শেরপুরের আগ্রহী
ব্যক্তিরা জানান, মৎস্য খামার ও বিভিন্ন কৃষি খামারের মতো সরকারী
পৃষ্ঠপোষকতা বা সাহায্য সহযোগিতা পেলে কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে
দ্রুত শেরপুর জেলার চিত্র পাল্টানে সম্ভব।
শেরপুর বিসিক ফিড অফিস সূেত্র জানা যায়, ইতোমধ্যে এই বিসিক মাঠে খাদ্য ও
খাদ্যজাত সংক্রান্ত ১২টি ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। এরমধ্যে
রয়েছে, বিভিন্ন মশলা তৈরি, আলুর হিমাগার, মুড়ি ও চিড়া মিল, অটো রাইছ মিল
এবং ফিস ফিড।
জেলা কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক মোহিত কুমার দে বলেন, জেলায় যে পরিমাণের
সবজির চাষ হয় তাতে জরুরী ভিত্তিতে একটি সবজির হিমাগার প্রয়োজন। শিল্প ও
হিমাগার আসলে সরকারীভাবে খুব একটা হয় না। আর এ ক্ষেত্রে প্রথমে
উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। তারপর সরকারী ঋণ ও অন্যান্য বিষয়ে অবশ্যই
সুবিধা পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, শেরপুর জেলায় যে পরিমাণের আলু উৎপাদন হয়
তা হিমাগারের অভাবে অনেক কৃষক আলুর ন্যায্য মূল্য পায় না। আবার অনেকের
আলু নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু শেরপুরে যদি কেউ পটেটো চিপস তৈরির কারখানা বা
শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে তবে কৃষকরা আলু উৎপাদনে আরো আগ্রহী হয়ে উঠত।
এছাড়া টমেটো দিয়ে সস, আম দিয়ে আঁচার, রাবারসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে
তোলা সম্ভব। এ ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় কাসাভা বা শিমলা আলু (গ্লুকোজ তৈরির
কাঁচা মাল), চা ও রবার চাষ করে এখানে ওইসব শিল্প প্রতিষ্ঠান গোড়ে তোলা
সম্ভব। এতে জেলার কৃষকদের ভাগ্যের উন্নয়ন হতো।