জলবায়ু পরিবর্তনে বঙ্গোপসাগর উপকূলে সূয়েপ পানির সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। উপকূলীয় উপজেলা খুলনার পাইকগাছা ও কয়রা। এ দুটি উপজেলায় প্রায় ৪ লক্ষ মানুষের বসবাস। জলবায়ু পরিবর্তনে এখানকার প্রধান সমস্যা বিশুদ্ধ পানির সংকট। শুকনো মৌসুম এলেই উপকূলজুড়ে প্রতি বছর খাবার পানির জন্য চলে হাহাকার। চারিদিকে পানি থাকলেও খাবার উপযোগী পানি নেই কোথাও, সবই লবণাক্ত। চৈত্রের খরার আগেই প্রাকৃতিক উৎসগুলো শুকিয়ে যায়। পাইকগাছায় মোট অগভীর নলকূপ রয়েছে ২ হাজার ৬৫৩টি। এ ছাড়া ভিএসএসটি ৩১টি, এসএসটি ৬১৮টি, রেইন ওয়াটার হার্ভেষ্টিং ৭৪৮টি ও পিএসএফ ৪৯৪টি। কোনো কিছুতেই যেন নিরসন হচ্ছে না সূপেয় পানির সংকট। কেননা অধিকাংশ নলকূপগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক, আয়রণ ও লবণাক্ত। বিকল্প হিসেবে পুকুর নদীর পানি ব্যবহার করছে। আবার অনেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পান করে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় মিষ্টি পানির আঁধার নেই সেসব এলাকায় বৃষ্টির পানিই একমাত্র ভরসা। পাইকগাছায় লোকসংখ্যা ২ লাখ ৪৭ হাজার ৯৮৩জন এবং কয়রায় ১ লাখ ৯৩জন। সর্বশেষ পাইকগাছায় ২০১৩ সালে ১২ হাজার ৪৯১টি নলকূপ পরীক্ষা করে ৮হাজার ৭৬টি নলকূপে আর্সেনিক ধরা পড়ে। যার আর্সেনিকের গড় পরিমাণ ছিলো ৬৫ শতাংশ। প্রায় এক দশক পর আবারও আর্সেনিক পরিক্ষা বর্তমান চলমান বলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তর সূত্রে প্রকাশ। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের তথ্যমতে, বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে এ দু’উপজেলার নদ-নদীর সংযোগ রয়েছে। ফলে সাগরের লোনাপানি সরাসরি উপজেলা গুলোতে পৌঁছে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, নদ-নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় নষ্ট হয়েছে সুপেয় পানির আধার। বর্ষা মৌসুমে ধরে রাখা খাবার পানির পুকুরগুলোও শুকিয়ে গেছে। বাড়ির গৃহিণীসহ অন্য সদস্যরা কলস নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে পানি সংগ্রহ করছেন। প্রলয়ঙ্ককারী ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, আম্ফান, ইয়াস, ফণি, বুলবুলের আঘাতে বিধ্বস্ত এ উপকূলীয় মানুষ। এখনো উপকূলের যেসব পুকুরে ধরে রাখা সামান্য বৃষ্টির পানি রয়েছে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করতে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে নারী-পুরুষ ও শিশুদের। এরপর পানি পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে লাইনে। পানি সংগ্রহের জন্য কোনো সময় পুরো দিন পার হয়ে যায় তাদের। অনেকে বাধ্য হয়ে নিত্যদিনের কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহার করে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী পাইকগাছায় ৩৩.৮৭ শতাংশ আর কয়রা উপজেলায় ৩৯.৭৯ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে বলে জানানো হলেও বাস্তবে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। পানি সংকট নিরসনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে উপকূলজুড়ে পুকুর খনন, টিউবওয়েল স্থাপন, পন্ডস অ্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) স্থাপন এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করলেও কোনো ভাবেই সংকট দূর হচ্ছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে, প্রতি লিটার পানিতে ০ থেকে ১ হাজার মিলিগ্রাম লবণ থাকলে সেই পানি পানযোগ্য। উপকূলে প্রতি লিটারে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার মিলিগ্রাম লবণ রয়েছে। মাঠ পরিদর্শনে উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে পানি কষ্ট চোখে পড়ে। পানির সংগ্রহের জন্য মানুষগুলো দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটে। এভাবে পানি সংগ্রহ করতে দেখা যায় শিশু এমনকি বৃদ্ধদেরও। সূত্র বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন এই এলাকায় লবণাক্ততা বাড়িয়েছে। আইলার আগে এই এলাকায় এতটা পানির সংকট ছিল না। কিন্তু আইলার প্রলয়ে সুপেয় পানির সবগুলো আঁধার লবণ পানিতে ডুবে যায়। সেগুলো থেকে এখন আর লবণ পানি সরানো যাচ্ছে না। ফলে মিঠা পানির সংকট দিন দিন বাড়ছে। পাইকগাছায় তেতুলতলা গ্রামের গৃহিণী শিউলী মন্ডল ও নাহিদা আক্তার এফএনএসকে বলেন, এক কলস খাবার পানির জন্য মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়। তাও আবার দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে এক কলস পানি নিতে হয়। ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ত এলাকা সম্প্রসারণের প্রেক্ষিতে সুপেয় পানির সন্ধানে’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে পানি কমিটি বলছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল এলাকায় লবণাক্ততার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ জলাধারের বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ এলাকার অবস্থান ব-দ্বীপের নিম্নাংশ। ফলে নদী বাহিত পলির আধিক্য বেশি। এ কারণে ভূগর্ভে জলাধারের জন্য উপযুক্ত মোটা দানার বালু বা পলির স্তর খুব কম পাওয়া যায়। আর পলির স্তর পাওয়া গেলেও এই বালুর স্তরের পুরুত্ব খুবই কম। আর কোথাও কোথাও এই বালুর স্তরের ভূমি থেকে অনেক গভীরে। সেখান থেকে মিষ্টি পানি উত্তোলন অত্যন্ত দুরূহ। আমরা পানির অভাবের মধ্যে বসবাস করছি। অনেক কষ্টে খাবার সংগ্রহ করতে পারি। কিন্তু পানি সংগ্রহ করা আমাদের জন্য খুবই কঠিন। কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী গ্রামের কয়েকজন গৃহিনী এফএনএসকে কথাগুলো বলেন। পাইকগাছায় গোপাল সরকার এফএনএসকে বলেন, উপকূলে এক দশক আগে যেমন পানিকষ্ট ছিল, এখন সেই সংকট আরও কয়েকগুন বেড়েছে। ঘরের সবদিকে পানি। অথচ খাবার পানির জন্য আমাদের যুদ্ধ করতে হয়। বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড় এই এলাকার ব্যাপক ক্ষতি করেছে। বহু মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফলে জীবন জীবিকার অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে এই এলাকায় খাবার পানি সংকটও তীব্র হয়েছে। পানি সংকট নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যের ইম্পোরিয়াল কলেজের সমীক্ষা। সেখানে বলা হয়েছে, বছরের ৩-৪ মাস বৃষ্টির পানি এই এলাকার মানুষের পানি সংকট কিছুটা লাঘব করে। অন্য সময় এদের কষ্টের সীমা থাকে না। পাইকগাছা-কয়রা উপজেলায় পানি ও স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি এনজিও ডরপ তার শাখা ব্যস্থাপক আবু সায়েম এফএনএসকে বলেন, বর্ষাকালে এলাকার মানুষ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে। কিন্তু বড় ট্যাংকির অভাবে অনেক পরিবারের পক্ষে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। কিছু পরিবার পুকুরের পানিতে ফিটকিরি প্রয়োগ করে ব্যবহারযোগ্য করে নেয়। দুর্যোগের কারণে অনেক স্থানের পুকুর ডোবায় পরিণত হয়েছে বা ভরাট হয়ে গেছে। সংকট ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার রেশ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত ১১টি উপকূলীয় জেলার ৬৪টি উপজেলার প্রায় ৫০ লাখ দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বড় অংশ বয়ে চলেছে। উপকূলীয় মাটিতে বর্তমানে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৬-১৫.৯ পিপিটি; অথচ মাটির সহনীয় মাত্রা ০.৪-১.৮ পিপিটি। লবণাক্ততার কারণে গাছপালার পরিমাণও আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। পুকুরে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে মাছসহ জলজ প্রাণীও মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাইনর ইরিগেশন ইনফরমেশন সার্ভিস ইউনিট পরিচালিত ‘দক্ষিণাঞ্চলের ভূগর্ভে লবণ পানির অনুপ্রবেশ পূর্বাভাস প্রদান’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ভূগর্ভস্থ পানিতে বঙ্গোপসাগর থেকে লবণ পানি এসে মিশছে। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধার বাইরে। যার বেশিরভাগই বাস করে উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলে। বাংলাদেশ সেন্টার ফর এডভাসড স্টাডিজ (বিসিএএস)-এর নির্বাহী পরিচালক ক্লাইমেট চেঞ্জ এক্সপার্ট ড. আতিক রহমান বলেন, বাংলাদেশকে বলা হয় গ্রাউন্ড জিরো অব ক্লাইমেট চেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সম্ভবত বাংলাদেশই হবে। বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল একদম সমতল। এতটাই সমতল যে, এক মিটার পানি বাড়লে ১৭ ভাগ ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমুদ্রের উপরের লবণাক্ত পানি নিচের দিকে যায়। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে পানি ভেতরে ঢুকছে। যে পানি ঢুকছে, সেটা লবণ পানি। এই লবণ পানি ক্রমেই বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নয়, লবণাক্ততা বৃদ্ধির অন্যান্য কারণও আছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে, উপরের দিকে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যাওয়া। সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবু এফএনএসকে বলেন, পাইকগাছা-কয়রা উপজেলায় কোনো গভীর নলকূপ কাজে আসে না। অগভীর নলকূপের পানি পান করা যায় না। ফলে এই অঞ্চলের মানুষের সুপেয় পানির কষ্ট দশকের পর দশক ধরে, যা নিরসনের চেষ্টা করেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণের জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্প দাখিল করা হয়। সর্বশেষ গত ১ফেব্রুয়ারী পরিকল্পনা কমিটিরসভায় উপকূলীয় পাইকগাছা-কয়রা উপজেলায় সুপেয়পানি সংকট নিরসনে ৩৪.৭৯ কোটি টাকার নতুন এ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনুমোদিত এ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রেইন ওয়াটার হারভেষ্ট (ট্যাংকি), গভীর নলকূপ, ওয়াস ব্লকসহ নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা।